পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই ৫ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি

ফানাম নিউজ
  ০৪ এপ্রিল ২০২২, ১২:৪৮

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব আনলে সেটি খারিজ হয়েছে গতকাল রোববার (৩ এপ্রিল)।

এরপর প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে ভোটের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তার প্রস্তাবে অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। ফলে পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করা হচ্ছে না ইমরান খানেরও।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কোনো প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে পারেননি। নানাবিধ কারণে সেটি সম্ভব হয়নি দেশটিতে।

পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯৫১ সালে ১৬ অক্টোবর জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। চার বছর ৬৩ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।

লিয়াকতের পর খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধান হন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ অগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। সে সময় বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহৌরে একাধিক সহিংস ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি সেটি না করায় নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন মালিক। নাজিমুদ্দিন এক বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন বলে জানা যায়।

এর পরে প্রধানমন্ত্রী হন মহম্মদ আলি বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দু’বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ছিলেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বোগরার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বোগরাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার।

পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরি মহম্মদ আলি। ১৯৫৫ সাল থেকে এক বছরের কিছু বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন তিনি। দলবিরোধী কার্যক্রমের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।

পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হুসেইন শাহিদ সুরাবর্দি। তিনি ১৯৫৬ থেকে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে পড়ে সুরাবর্দিও গদি ছা়ড়তে বাধ্য হন।

পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দুমাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।

এরপর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের দায়িত্ব সামলানোর ভার নেন ফিরোজ খান নুন। তার শাসনকালের সময় ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়ে ফিরোজ জনপ্রিয়তা হয়ে উঠেন। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দখলের ইচ্ছায় ফিরোজ বাধ সাধতে পারেন, এই ভয়ে তাকেও গদিচ্যুত করেন ইসকান্দার।

অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল। তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি নিজেই পদ ছাড়েন।তিনিই পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ ভাইস প্রেসিডেন্টও। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।

এরপর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতায় বসেন। ১৯৭৩ সাল থেকে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মহম্মদ জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে।

জুলফিকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় মহম্মদ খান জুনেজোকে। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় মসনদে ছিলেন। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরানো হয়।

পাকিস্তানের একাদশ ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় বসেন জুলফিকারের কন্যা বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দুবছর ক্ষমতায় ছিলেন। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৯০ সালে দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি পদচ্যুত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই ৫ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি

ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির এবং নওয়াজ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্তসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দু’বছর ২৩৭ দিন। এর পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।

বেনজির ও নওয়াজের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন মির জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দু’বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন।

ষষ্ঠদশ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধরি সুজাত হোসেন। তার শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এর পর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।

এরপর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন শওকত আজিজ। মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান।

শওকতের পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট তার প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করে।

২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দুবার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ। তবে তৃতীয় বারে চার বছরের ৫৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যূত করে সুপ্রিম কোর্ট।

নওয়াজের পর ৩০৩ দিনের জন্য একুশতম পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহিদ খোকন আব্বাসি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তার জোট সঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। ইমরান খানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না।

সূত্র: বিজনেজ টুডে, আনন্দবাজার