শিরোনাম
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল, অর্থনীতির নাজুক অবস্থা কিংবা সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন প্রভাব– ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই তাদের ক্ষমতার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। অনাস্থা ভোটের কারণে ইমরান খান যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে সেই তালিকায় যোগ হবে তার নামও।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটিশদের কাছ থেকে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের প্রায় প্রত্যেক ক্ষমতাসীন সরকারই দায়িত্ব পালনের সময় নানা বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন।
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটির সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের কারণে অন্তত চারটি বেসামরিক সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
এছাড়া দেশটির ইতিহাসের অর্ধেক সময়ই ছিল সামরিক শাসনের অধীনে।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তানের সংবিধান স্থগিত করে ১৯৫৮ সালে দেশটিতে মার্শাল ল জারি করেন।
মার্শাল ল জারির ১৩ বছর পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৭৩ সালে বিশেষ ব্যবস্থায় সংবিধান পাসের পর তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন।
১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের নির্বাচনে জয় লাভ করে ভুট্টো। ওই বছর দেশটির সেনা জেনারেল জিয়া-উল-হকের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জেনারেল জিয়া-উল-হকের মৃত্যুর পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু তার শাসনকাল মাত্র তিন বছর টেকে। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে মতপার্থক্য দেখা দেয়ায় জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন বেনজির ভুট্টোও।
এরপর ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। তবে সামরিক বাহিনীর চাপে পড়ে ১৯৯৩ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বাধ্য হন নওয়াজ শরিফও।
১৯৯৩ সালের নির্বাচনে বেনজির ভুট্টো জয়ী হতে না পারলেও তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় ফের ক্ষমতায় আসেন তিনি।
১৯৯৬ সালের ৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘারি জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন। ফলে বেনজির ভুট্টোকে ফের ক্ষমতা ছাড়তে হয়।
এরপর ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) জয়লাভ করে। তবে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে তৎকালীন সেনা জেনারেল পারভেজ মুশাররফ জরুরি অবস্থা জারি করে নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন।
মুশাররফের শাসনামলে পাকিস্তানে তিনজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেন। তারা হলেন, মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি, চৌধুরী সুজাত এবং শওকত আজিজ।
২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তানের পিপলস পার্টি (পিপিপি) সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাখ করে। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন রাজা ইউসুফ গিলানী। তার মেয়াদ অবশ্য বেশ সুন্দর ভাবেই চলছিল। কিন্তু ২০১২ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার একটি মামলার কারণে সেই গতিতে ছেদ পড়ে। এরপর তার ক্ষমতার বাকি এক বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন রাজা পারভেজ আশরাফ।
নওয়াজ শরিফ ২০১৩ সালে ফের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। তবে পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হওয়ায় তার ক্ষমতার মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেন। তার মেয়াদের বাকি সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন শহীদ খোকন আব্বাসি।
এরপরই পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবির্ভাব ঘটে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। ২০১৮ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনার পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়।
জনপ্রিয় এই ক্রিকেটারের প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং ভুল পররাষ্ট্রনীতির কারণে ব্যাপক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঐকবদ্ধভাবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব তুলেছে।
ইমরান খান সরকারের অন্যতম মিত্র মুত্তাহিদা কউমি মুভমেন্ট-পাকিস্তান (এমকিউএম-পি) বুধবার জোট থেকে চলে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় তার ক্ষমতা থেকে বিদায় সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে ইমরান খানও সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। তার সরকারের পেছনের বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অভিযোগ করেছেন তিনি। ইসলামাবাদে ইমরান খানের এই জনসভায় ব্যাপক জনসমাগমও হয়েছে।
এদিকে, গদি বাঁচাতে ইমরান খান গোপন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আগাম নির্বাচন ঘোষণা দিতে পারেন বলে সরকারের উপর মহলের গোপন সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা পিটিআই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে।
পাকিস্তান সরকারের ওপর মহলের ওই সূত্র বৃহস্পতিবার পিটিআই জানান, অনাস্থা ভোট নিয়ে তেহরিক-ই-ইনসাফ সরকার ও বিরোধী জোটের সঙ্গে একটি গোপন প্রচেষ্টা চলছে।
ওই সূত্র আরও জানায়, সব আলোচনা একদিকেই যাচ্ছে। তা হলো, বিরোধী জোট ইমরান খানের ওপর থেকে অনাস্থা প্রস্তাব তুলে নেবে। বিনিময়ে ইমরান খান সংসদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেবেন।
অন্যদিকে, ঘনিষ্ঠরা দাবি করছেন, পাকা খেলোয়ার ইমরান খান শেষ বল পর্যন্ত খেলবেন।
এখন রাজনীতির ক্রিজে টিকে থাকার লড়াইয়ে কোনো মিরাকলের মাধ্যমে শেষ মুহূর্তে সাবেক এই ক্রিকেট তারকা ছক্কা হাকাবেন নাকি পূর্বসূরিদের পদাঙ্গ অনুসরণ করে পদত্যাগ করবেন, সেটাই দেখায় বিষয়।