রুশ সেনাদের প্রতিহত করতে চায় ভিন্ন পথে হাঁটছে ইউক্রেন

ফানাম নিউজ
  ০৭ মার্চ ২০২২, ১৪:২৩

ভোরের আলো না ফোটলেও তখনও গুগল ম্যাপসে দেখাচ্ছিল, রাশিয়ার বেলগোরোদ থেকে ইউক্রেন সীমান্ত পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট। আসলে দুঃসময়ে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক মনে হলেও যা বোঝার, তা বুঝে গেলেন ড. জেফরি লুইস। টুইটারে তিনি লিখলেন, ‘সামওয়ানস অন দ্য মুভ।’ রুশ সেনাবহর যে এগোতে শুরু করেছে, সে ইঙ্গিতই দেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার মিডলবারি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের অধ্যাপক জেফরি। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ঘটনাটি ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় ভোর সোয়া তিনটার দিকে অনুমান করেন তিনি। পুরোপুরি নিশ্চিত না হলেও দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেন। কারণ, বাণিজ্যিক স্যাটেলাইট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কাপেলা স্পেসের পাঠানো রাডার ছবিতে ঠিক ওই জায়গায় এর আগে তিনি রুশ সেনাদের তাঁবু দেখেছিলেন।

জেফরির সে অনুমানের ঘণ্টা কয়েক পর যুদ্ধের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এরপর নানা দিক থেকে বিস্ফোরণে কেপে ওঠে ইউক্রেন।

ইউক্রেন ও রাশিয়ার বিবাদ নতুন নয়। ২০১৪ সালে যেমন ক্রিমিয়া দখল করে নিয়েছিল রুশ সেনাবাহিনী। তবে সেবার কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইটের বহুল ব্যবহারের খবর মেলেনি, যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। ইউক্রেনে এবারের রুশ হামলার সবচেয়ে আইকনিক ছবিটিও বোধ হয় উপগ্রহ থেকেই তোলা। দীর্ঘ রুশ সেনাবহরের বহুল প্রচারিত সে ছবি ম্যাক্সার টেকনোলজিসের। আবার ব্ল্যাকস্কাই নামের আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠানের উপগ্রহচিত্রও সংবাদমাধ্যমে বেশ দেখা যায়।

যুদ্ধে উপগ্রহচিত্র ব্যবহারের সমস্যা যেখানে

স্যাটেলাইট থেকে তোলা রুশ সেনাবহরের গতিবিধির ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ তো হচ্ছেই, যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণে সে ছবি ব্যবহার করছে ইউক্রেনের সরকারও। তবে ম্যাক্সার কিংবা ব্ল্যাকস্কাইয়ের মতো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সরবরাহকৃত স্যাটেলাইট চিত্র রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে কাজে আসছে না। এর প্রথম কারণ, ছবিগুলো তাৎক্ষণিক (রিয়েল টাইম) নয়। চাইলেই পৃথিবীর নির্দিষ্ট জায়গার ঠিক এ মুহূর্তের স্যাটেলাইট ছবি পাওয়া যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় কারণটা হলো, বছরের এ সময়ে ইউক্রেনের আকাশ সচরাচর মেঘাচ্ছন্ন থাকে। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচলিত স্যাটেলাইট দৃশ্যমান চিত্রের পাশাপাশি বড়জোর ইনফ্রারেড-চিত্র ধারণ করে পাঠাতে পারে। এর মানে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলে কিংবা রাতের অন্ধকারে তোলা ছবি তেমন কাজে আসবে না। সে কথাই ইউক্রেনীয় উদ্যোক্তা ম্যাক্স পলিয়াকোভ বারবার বলছেন। তাঁর ভাষায়, রুশ আক্রমণ ঠেকাতে হলে উপগ্রহচিত্র তাৎক্ষণিক ও বিনা মূল্যে দরকার। এরপর নিজের প্রতিষ্ঠান ইওএস ডেটা অ্যানালিটিকসের মাধ্যমে সে চিত্র বিশ্লেষণ করে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেবেন তিনি।

২৮ ফেব্রুয়ারি সংবাদকর্মীদের পলিয়াকোভ বলেন, ‘আমাদের যথেষ্ট যোদ্ধা আছে...আমাদের সীমানার মধ্যে থাকা রুশ সেনাদের প্রতিহত করার মতো যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। আমরা কেবল জানি না, তারা কোথায় থেকে আক্রমণ চালাবে। তা ছাড়া রাতে আমরা অন্ধ। কারণ, আমাদের হাতে পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য (ইন্টেলিজেন্স) নেই।’

ম্যাক্সারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ছবি সংবাদমাধ্যমে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত হলেও প্রতিপক্ষকে কাবু করার জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন পলিয়াকোভ। সে কাজে দরকার তাৎক্ষণিক তথ্য। সে কারণেই যে প্রতিষ্ঠানগুলো ‘রাডার-চিত্র’ সরবরাহ করতে পারছে, তাদের এখন বেশ চাহিদা। কারণ, রাডার-চিত্র রাতেও সমান কার্যকর, মেঘেও বাধা পায় না।

রাডার-চিত্র তৈরি করা হয় সিনথেটিক অ্যাপারচার রাডার (এসএআর) স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া উপাত্তের ভিত্তিতে। বাদুড় অন্ধকারে যেভাবে চলে, এটাও একই ধরনের প্রযুক্তি। শুরুতে উপগ্রহ থেকে বেতার তরঙ্গ পাঠানো হয় পৃথিবীতে। এরপর সে তরঙ্গ কীভাবে ফিরে যাচ্ছে, তা ধারণ করে রাডার-চিত্র তৈরি করা হয়। বাণিজ্যিক উপগ্রহ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এ চিত্র নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে প্রায় যে কারও কাছে বিক্রি করে থাকে।

যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করে রাডার-চিত্র

এ ধরনের রাডারের তথ্য গবেষণায় ব্যবহার করেন বাংলাদেশি শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। রাডার-চিত্র তৈরির ধরন সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য স্যাটেলাইটের সঙ্গে সিনথেটিক অ্যাপারচার রাডার স্যাটেলাইটের পার্থক্য হলো, এটা যেকোনো আবহাওয়ায় কাজ করে। প্রথমে স্যাটেলাইট থেকে বেতার তরঙ্গ পাঠানো হয়। এরপর ভূমি থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে যাওয়া তরঙ্গের তথ্য রেন্ডার করে দৃশ্যমান ছবি তৈরি করা হয় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রে। অ্যাকটিভ সেন্সর কাজে লাগানোয় এতে প্রায় তাৎক্ষণিক তথ্য পাওয়া যায়।

আলোর প্রতিফলন কাজে লাগিয়ে যেমন স্মার্টফোনের ক্যামেরায় ছবি ধারণ করা হয়, প্রচলিত স্যাটেলাইটে চিত্র ধারণের প্রযুক্তি অনেকটা কাছাকাছি। তবে রাডার-চিত্রে তরঙ্গের প্রতিফলনের উপাত্ত ব্যবহার করে ছবি তৈরি করে নিতে হয়। সেই ছবি কি সমান কার্যকর? রাডার-চিত্র দেখে কি বলে দেওয়া সম্ভব, কিয়েভ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে তিনটি ট্যাংক এখন উত্তর দিকে এগোচ্ছে? আশরাফ দেওয়ান বললেন, সম্ভব। সুনির্দিষ্ট করেই বলে দেওয়া সম্ভব। তবে রাডার-চিত্র অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া সচরাচর ব্যবহার করা হয় না।

ইউক্রেন কেন রাডার-চিত্র চায়

আগেই বলা হয়েছে, কেবল গবেষক নয়। ইউক্রেনের সরকারও এ তথ্য চায়। ম্যাক্স পলিয়াকভের বক্তব্য সমর্থন করে টুইটারে আটটি রাডার-চিত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী মিখাইলো ফেদোরভ। তিনি বলেছেন, ‘রুশ সেনাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের সুযোগ দরকার আমাদের, বিশেষ করে রাতে যখন আমাদের প্রযুক্তি কাজে আসে না।’

ইউক্রেনের ওপর এখন গোটা পঞ্চাশেক স্যাটেলাইট কাজ করছে বলে ধারণা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অধ্যাপক টড হামফ্রেজের। এর পাশাপাশি তুরস্কের তৈরি ড্রোনেও নজর রাখার চেষ্টা চলছে বলে ‘ওয়্যার্ড’ সাময়িকীর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

আছে নানা প্রশ্নও

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যে ধরনের স্যাটেলাইট চিত্র সরবরাহ করছে, তা একসময় কেবল সরকারের কাছেই ছিল। তবে গোপনীয়তার স্বার্থে সব ছবি তারা প্রকাশ করত না। এখন সে পরিস্থিতি বদলেছে ঠিকই, তবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ থাকায় নৈতিকতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নও উঠছে। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের হাতে নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছে কি না, তা ভেবে দেখার আহ্বানও জানিয়েছেন বিশ্বের অনেক গবেষক।

এ ছাড়া উপগ্রহচিত্র যাচাই করার সুযোগ কম। যেমন এ ধরনের ছবি যুক্ত করে কোনো সংবাদ পরিবেশন করলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স প্রতিবার উল্লেখ করছে, এই ছবিগুলো আলাদা করে যাচাই করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। অর্থাৎ উপগ্রহ সেবাদাতারা যা বলছে, তা চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে হচ্ছে।

আবার মনে করুন, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধে কোনো বাণিজ্যিক উপগ্রহ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান যদি একটি দেশের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অপর পক্ষকে কোনো তথ্য না দেয়, তবে অসমতা তৈরি হতে পারে।

মিখাইলো ফেদোরভের উল্লেখিত আটটি প্রতিষ্ঠানের একটি হলো কাপেলা স্পেস। যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রশ্ন উড়িয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পায়াম বানাজাদাহ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমাদের যে সক্ষমতা, অনেক দেশের সরকারের তা নেই। আমরা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের কাছে যদি ছবি থাকে, তবে যে কেউ তা কিনতে পারে।’

আশরাফ দেওয়ানের কথাতেও সেটি পরিষ্কার। তিনি বললেন, এসএআর স্যাটেলাইটের তথ্য কেবল বিশেষ ক্ষেত্রে যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশির ভাগ সময় কিন্তু গবেষণাতেই ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া অর্থ খরচ করলেই এ তথ্য মিলছে।

রাশিয়া কি ছেড়ে কথা বলবে

কাপেলা স্পেস অবশ্য বলছে, বর্তমানে তারা ইউক্রেনের রাডার-চিত্র কেবল ইউক্রেন ও মার্কিন সরকারকে দিচ্ছে। এখানেও বিপত্তি আছে। কারণ, রাশিয়া চুপচাপ বসে থাকবে বলে মনে হয় না। প্রথমত, সাইবার হামলা ও আড়ি পাতার মাধ্যমে এ তথ্য হাতিয়ে নিতে কিংবা বিকৃত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, নভেম্বরে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নিজেদের একটি উপগ্রহ ধ্বংস করে দেখিয়েছিল রাশিয়া। প্রয়োজনে মার্কিন উপগ্রহে একই ধরনের হামলা যে তারা চালাবে না, তা নিশ্চিত করে বলার সুযোগ কই?

লেখার শেষে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। অধ্যাপক জেফরি লুইস গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে গুগল ম্যাপসে অস্বাভাবিক ‘যানজট’ দেখে অনুমান করেছিলেন যে ইউক্রেন আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে রুশ সেনাবহর। তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। কারণ, যুদ্ধের ময়দানে সেনাসদস্যরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে গুগল ম্যাপসে নিজেদের উপস্থিতির প্রমাণ দেবেন, এত বড় ভুল রুশ সেনাদের করার কথা নয়। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন জেফরি নিজেই। হতে পারে রুশ সেনাবহরের বাধায় সাধারণ জনগণ পথে আটকা পড়ায় গুগল ম্যাপস ওই যানজট দেখিয়েছে। এ ছাড়া ভ্লাদিমির পুতিনের ঘোষণার পর আক্রমণ শুরু হয় পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস থেকে।

যা হোক, সে ঘটনার দিন চারেক পর গুগল ঘোষণা দেয়, ইউক্রেনের রাস্তায় যানজটের তাৎক্ষণিক হালচাল জানানো আপাতত বন্ধ রাখছে তারা। কারণ না দর্শালেও গুগলের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—লড়াইয়ে হামলার লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণে কোনো ভূমিকা রাখতে চায় না তারা।