শিরোনাম
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিকদের আটকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ। রাশিয়া থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
রুশ বাহিনীর হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে। হামলার দশম দিনে গতকাল শনিবার দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দুটি শহর মারিউপোল ও ভলনোভাখায় পাঁচ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। যদিও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এরই মধ্যে অন্য শহরগুলোতে রুশ বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উত্তর–পশ্চিমের শহর ইরপিন, দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ, উত্তরাঞ্চলীয় চেরনিহিভ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সুমি শহরে হামলা হয়েছে। এসব শহর ঘিরে রেখেছেন রুশ সেনারা। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মিকোলেইভের দিকে এগোচ্ছে রুশ বাহিনী। শহরটি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী ওডেসা দখলের দিকে এগিয়ে যাবে তারা।
রুশ বাহিনীর সর্বাত্মক হামলার মুখে ইউক্রেনে ‘নো-ফ্লাই জোন’ (বিমান উড্ডয়ননিষিদ্ধ এলাকা) ঘোষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাঁর এ আহ্বানে সাড়া দেয়নি ন্যাটো। শুক্রবার ব্রাসেলসে জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক শেষে ন্যাটোপ্রধান ইয়ানেস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এটা করা হলে পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো হবে। তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। এ বিষয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গতকাল বলেছেন, কোনো দেশ ইউক্রেনে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করলে ধরে নেওয়া হবে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এরপরে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। অবিলম্বে ইউক্রেন বাহিনীকে জঙ্গিবিমান দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি। আর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত মস্কো গিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এদিকে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রয়েছে। মাইক্রোসফট, স্যামসাংসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান এবং জারার মতো ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো রাশিয়ায় কার্যক্রম বন্ধ করছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন-ঘনিষ্ঠ ধনকুবেরদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। জবাবে ক্রেমলিন বলেছে, পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে দস্যুর মতো আচরণ করছে। কিন্তু শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে পৃথিবীটা অনেক বড় হওয়ায় রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করা অনেক দূরের বিষয়।
সাময়িক যুদ্ধবিরতি
রুশ বাহিনীর টানা কয়েক দিনের গোলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর মারিউপোল ও ভলনোভাখায়। পানি ও বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে মারিউপোল। ঘর উষ্ণ করার গ্যাস না থাকায় চরম দুর্দশায় পড়ে বাসিন্দারা। মারিউপোলের মেয়র ভাদিম বয়চেঙ্কো গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, টানা হামলা হচ্ছে। বাসিন্দাদের নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে দেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।
সাড়ে চার লাখ বাসিন্দার শহর মারিউপোলের পরিস্থিতি কয়েক দিন ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এলেও পাশের ছোট শহর ভলনোভাখার বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায়নি। গতকাল সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পর মারিউপোল ও রুশপন্থীদের নিয়ন্ত্রণাধীন দোনেৎস্কের মধ্যবর্তী এ শহরের অবস্থা জানা যায়। ২৫ হাজার বাসিন্দার এ শহরেও কয়েক দিন তুমুল লড়াই হয়েছে। বাসিন্দারা গতকাল যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে বলেন, শহরের প্রায় প্রতিটি ভবন হয় ধ্বংস, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থানীয় এমপি দিমিত্রো লুবিনেতস বলেন, লড়াই এত তীব্র ছিল যে শহরের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এ পরিস্থিতিতে গতকাল শহর দুটি থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয় রুশ বাহিনী। উভয় পক্ষের মতৈক্যের ভিত্তিতে স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে তা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর বন্ধ হয়ে যায়। এর জন্য ইউক্রেন ও রাশিয়ার পক্ষ থেকে একে অপরকে দায়ী করা হয়। শহর দুটি থেকে উদ্ধার করে বেসামরিক ব্যক্তিদের নেওয়া হচ্ছিল পশ্চিম দিকের জাপোরিঝিয়া শহরে। তবে ওই শহরের দিকেও এগিয়ে যাচ্ছেন রুশ সেনারা। ইউক্রেন থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক চার্লস স্ট্যার্টফোর্ড বলেন, এ শহরও আক্রান্ত হতে চলেছে। শহরজুড়ে ট্যাংক আটকানোর ব্যবস্থা, তল্লাশিচৌকি ও হাজারো প্রতিরোধযোদ্ধা রয়েছে। অপর দিকে রুশ বাহিনী এগিয়ে আসছে।
মানবঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ
ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বিদেশি ও বেসামরিক নাগরিকদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছে রাশিয়া। গতকাল দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেন, রাশিয়া নিরাপদে সরে যাওয়ার পথ করে দিতে চাইলেও ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ সাড়া দিচ্ছে না। খারকিভ শহর থেকে বিদেশি শিক্ষার্থীসহ বেসামরিক ব্যক্তিদের সরিয়ে নিতে রাশিয়ার দেড় শ বাস খাবার, পানি ও গরম কাপড় নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও শহর কর্তৃপক্ষ তাতে রাজি হয়নি।
রাশিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা কমান্ড সেন্টারের প্রধান মিখাইল মিজিন্তসেভ অভিযোগ করেছেন, ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে সাড়ে ৭ হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিককে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। খারকিভ শহরেই ভারতের ৩ হাজার ১৮৯ জন, ভিয়েতনামের ২ হাজার ৭০০, জর্ডানের ২০০ ও মিসরের ৩০ জন নাগরিককে আটকে রাখা হয়েছে। ইউক্রেন বাহিনী বেসামরিক নাগরিক ও বিদেশিদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
ক্ষয়ক্ষতি
যুদ্ধে হতাহতের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। গত বুধবার ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ বলেছে, রুশ হামলায় দুই হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। পরদিন শুক্রবার ইউক্রেন সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ৯ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহতের দাবি করা হয়। অপর দিকে মস্কো তাদের ৪৯৮ জন সেনা নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ইউক্রেনের ২ হাজার ৮৭০ জন সেনা নিহত হয়েছেন বলেও দাবি করেছে তারা।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল বলেছে, ইউক্রেনের দুই হাজার সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮২টি জঙ্গিবিমান, ৭০৮টি সাঁজোয়া যান, ৭৪টি রকেট লঞ্চার ও ৫৬টি ড্রোন রয়েছে। অপর দিকে রাশিয়ার অন্তত ৩৯টি জঙ্গিবিমান ও ৪০টি হেলিকপ্টার ধ্বংস করার দাবি করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকোভ বলেছেন, যুদ্ধে যোগ দিতে বিভিন্ন দেশ থেকে ৬৬ হাজার ২২৪ জন ইউক্রেনীয় দেশে ফিরেছেন।
জীবন বাঁচাতে ইউক্রেন থেকে এ পর্যন্ত ১৩ লাখের বেশি মানুষ পাশের দেশগুলোতে পাড়ি জমিয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে। সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি গতকাল রয়টার্সকে বলেন, চলতি সপ্তাহের শেষে শরণার্থীর সংখ্যা ১৫ লাখে পৌঁছে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট দেখা যাচ্ছে।
এদিকে গতকালও যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে রুশ সেনাদের দখলে থাকা ইউক্রেনের শহর খেরসনেও। আগের দিন সার্বিয়ায় রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমর্থনে বিক্ষোভ হয়েছে।