মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে ইউক্রেনে হামলায় অনেক ভুল করেছে রুশ বাহিনী

ফানাম নিউজ
  ০৪ মার্চ ২০২২, ০৫:৩৩

মার্কিন বিশেষজ্ঞরা দাবি করেছেন, ইউক্রেনে হামলা করে এখনো সুবিধা করতে পারেনি রুশ বাহিনী। তারা পড়েছে অভাবনীয় এক বিপর্যয়ের মুখে। আক্রমণের প্রাথমিক পরিকল্পনা ও কৌশলে ভুল থাকায় তারা ভুগছে। এটা অনেককে বিস্মিত করেছে। রুশ সেনাদের খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি, সাঁজোয়া যান ছেড়ে পালানো, যুদ্ধবিমানের ক্ষয়ক্ষতি এবং সেনাসদস্যের মৃত্যুর সংখ্যায় তা প্রতীয়মান হয়।

বার্তা সংস্থা এএফপির এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ইউক্রেনে হামলার প্রথম দিনগুলোতে ব্যর্থতা মস্কোকে হতাশায় ভোগাতে পারে এবং সেই থেকে দেশটি সর্বশক্তি প্রয়োগ এবং নির্বিচার ইউক্রেনের বিস্তর এলাকা ধ্বংস করতে পারে। ইউক্রেনবাসীর প্রবল বাধার মুখে পড়ার বিষয়টিও ভাবেনি রাশিয়া।

রাশিয়ার সামরিক বাহিনী নিয়ে গবেষণা করা এই মার্কিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাঁরা অভিযানে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর অব্যবস্থাপনায় বিস্মিত হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে আক্রমণকারী সেনাদের মুখ থুবড়ে পড়া, কয়েক শ সাঁজোয়া যান হারানো, আকাশপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইউক্রেন বাহিনীর বাধার মুখে পড়া ইত্যাদি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‌্যান্ড করপোরেশনের জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক স্কট বোস্টন বলেছেন, ‘আপনি যদি দুই বা তিন সপ্তাহের মধ্যে কোনো কিছু ধ্বংস করতে চান, তাহলে আমি অবশ্যই বুঝতে পারব। তবে ঘরে ঢোকার পথে দরজার ফ্রেমের ওপর পড়ে গেলে তা অন্য কিছু বোঝাবে।’

ইউক্রেনের দুই লাখের বেশি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে ও বিমানবাহিনীকে পরাস্ত করে পুতিনের সেনাবাহিনী দ্রুত ইউক্রেনের লড়াই করার ক্ষমতা ধ্বংস করবে বলে ভেবেছিলেন মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা। 

কিন্তু ছয় দিনের লড়াইয়েও এসবের কিছুই হয়নি। এখন পর্যন্ত লড়াইয়ে হতাহতের বা ধরা পড়া রুশ সেনাদের প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে পরিকল্পিত রুশ আক্রমণে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে চলতি সপ্তাহে সাবেক মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অব ডিফেন্স মাইকেল ভিকারস বলেন, এটি একটি বিশাল গোয়েন্দা ব্যর্থতা, যা ইউক্রেনীয় প্রতিরোধকে ব্যাপকভাবে অবমূল্যায়ন করেছে এবং এতে সেনা মৃত্যুর হারও ভয়ানক। এটা বিপর্যয়ের পর বিপর্যয়।

রাশিয়ার যুদ্ধবিমান হারানো

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের স্কোক্রফ্ট সেন্টারের সামরিক বিশেষজ্ঞদের একটি মূল্যায়নে রুশ সেনাদের কিয়েভের বাইরে একটি বিমানবন্দর দ্রুততার সঙ্গে দখল এবং নিয়ন্ত্রণে রাখার গুরুত্বপূর্ণ ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, কিয়েভ আক্রমণের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিমানবন্দর নিয়ে লড়াইয়ের রুশ বাহিনী ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ছাড়া তাঁরা বলেছেন, রুশ যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার ধ্বংসের ঘটনা আশ্চর্যজনকভাবে অনেক বেশি। কারণ, তারা ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস না করেই এ আক্রমণ চালিয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, রাশিয়ার ইলেকট্রনিক যুদ্ধ অস্ত্রের সীমিত বা অকার্যকর প্রয়োগ। অনেক বিশ্লেষক ভেবেছিলেন, এই অস্ত্রই ইউক্রেনীয়দের যোগাযোগের ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

স্কোক্রফ্ট সেন্টারের প্রতিবেদন বলছে, রুশ সেনারা যদি ইউক্রেন সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের যোগাযোগব্যবস্থা ধ্বংস করতে পারতেন, তাহলে ইউক্রেনের বিমানবাহিনী ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যেত। এতে এত প্রাণহানি ঘটত না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউক্রেনীয় বাহিনী এখনো রাশিয়ার সাঁজোয়া যান ধ্বংসে তুরস্কের তৈরি বেরাক্তার ড্রোন ব্যবহার করছে। এসব ড্রোন যদি এক বা দুবার কোনো রুশ যুদ্ধবিমানে আঘাত হানে, তবে তা ঠিক আছে। কিন্তু এর বেশি হলে বুঝতে হবে রাশিয়ার বাহিনীর নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে।

খাদ্যঘাটতি

পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি বুধবার বলেছেন, রুশ বাহিনী তাদের বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় সামরিক ক্ষমতার সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া আক্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় রসদেরও ঘাটতির মুখে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, রুশ বাহিনীর হাতে অত্যাধুনিক সম্মিলিত অস্ত্রের ক্ষমতা থাকলেও তাদের সমন্বয়হীনতার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তাদের রসদে ঘাটতির বিষয়টিও একইভাবে আশ্চর্যের। কিরবি বলেন, ‘আমরা পরিত্যক্ত যানবাহন দেখছি। শুধু জ্বালানি নয়, তাদের খাদ্যঘাটতিরও ইঙ্গিত মিলেছে।’

আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, যুদ্ধে অংশ নেওয়া রাশিয়ার অধিকাংশ সেনা তরুণ। এ ধরনের সংঘর্ষের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রশিক্ষণ কম। সম্ভবত তাঁরা যুদ্ধে যাচ্ছেন, এ বিষয় সম্পর্কেও অবগত নন। ইউক্রেনে হামলা চালানোর চেষ্টার সময় কী করবেন, সেই বিষয়ে ধারণা নেই তাঁদের।

কিরবি বলেন, কোনো বিশেষজ্ঞই রুশদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখছেন না। তবে রুশ সেনাদের অগ্রগতি থেমে গেছে।

অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা এ-ও ভাবছেন যে প্রথম কয়েক দিনের হামলা নিয়ে পুতিনের হতাশা থেকে পুরো সামরিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমে যেতে পারে রাশিয়া। তাতে ইউক্রেনের জনগণের ওপর আরও ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে।
স্কোক্রফ্ট সেন্টারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, রাশিয়ার এখনো অপ্রতিরোধ্য যুদ্ধ শক্তি রয়েছে। এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে পিষে ফেলবে তারা।