শিরোনাম
রুপালি পর্দায় ছিলেন কৌতুক অভিনেতা। সেখান থেকে হুট করেই যোগ দেন রাজনীতিতে। নির্বাচিত হন প্রেসিডেন্ট। এখন তিনি বাস্তবে নায়কের ভূমিকায়।
উল্লিখিত ব্যক্তি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সামরিক ক্ষমতায় বহুগুণ এগিয়ে থাকা রুশ বাহিনীর আক্রমণের মুখে যিনি নিজের দেশ ছাড়েননি; বরং যুদ্ধের মধ্যেই রাজধানী কিয়েভের রাস্তায় ঘুরেছেন, সেনাদের সঙ্গে দেখা করে সাহস জুগিয়েছেন, নিজ দেশের মানুষকে প্রতিরোধযুদ্ধে উদ্দীপিত করেছেন।
রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের বেসরকারি জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘রেটিং সোশিওলজিক্যাল’ এ সপ্তাহের শেষে যে জরিপ পরিচালনা করেছে, তাতে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরের তুলনায় জেলেনস্কির প্রতি ইউক্রেনবাসীর সমর্থন তিন গুণ বেড়েছে। ৭০ শতাংশ ইউক্রেনবাসী মনে করে, জেলেনস্কি রাশিয়ার হামলা প্রতিহত করতে পারবেন। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও জেলেনস্কির জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
জেলেনস্কির জন্ম ১৯৭৮ সালে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার ইউক্রেনে একটি ইহুদি পরিবারে। তাঁর বাবা আলেকসান্দার জেলেনস্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা রায়মা জেলেনস্কা ছিলেন প্রকৌশলী। জেলেনস্কির দাদা সিমন ইভানোভিচ জেলেনস্কি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনী রেড আর্মির সদস্য ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ইহুদি নিধনযজ্ঞে সিমন জেলেনস্কি নিজের বাবা ও তিন ভাইকে হারান।
ভলোদিমির জেলেনস্কি ২০০০ সালে আইনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তবে তাঁর নেশা ছিল অভিনয়। গঠন করেন কমেডি দল ‘কভারতাল ৯৫’।
রুশভাষী হিসেবে বেড়ে ওঠা জেলেনস্কি কাজ করেছেন বেশির ভাগ রুশ ভাষার ছবিতে। ২০১৮ সালে তাঁর প্রথম ইউক্রেনীয় ভাষার ছবি আই, ইউ, হি, শি মুক্তি পায়। এটিই তাঁর শেষ ছবি। তবে ২০১৫ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া টিভি সিরিজ ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’-এ প্রেসিডেন্টের চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক পরিচিতি পান জেলেনস্কি। রাজনৈতিক ব্যঙ্গ বা পলিটিক্যাল স্যাটায়ারভিত্তিক ওই অনুষ্ঠান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ২০১৭ সালে এই টেলিভিশন অনুষ্ঠানের নামেই একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হয়। দলটি ২০১৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ১৩০টির মধ্যে ১২৪ আসন পায়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জেলেনস্কি।
ইউক্রেনে তিন বছর ধরে ক্ষমতায় জেলেনস্কি। এ সময়ে খুব বেশি আলোচনায় ছিলেন না তিনি। বিশ্বে বহু দেশের মানুষ হয়তো নামটাও ভালোভাবে জানতেন না।জেলেনস্কির জনপ্রিয়তার শুরুটা কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কল্যাণেই। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগ দেওয়া নিয়ে জেলেনস্কির আগ্রহ আর পুতিনের আপত্তি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন নিয়ে জেলেনস্কি-পুতিনের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যও চলেছে। আর এসব ঘটনায় জেলেনস্কির প্রতি আগ্রহ বেড়েছে বিশ্ববাসীর।
রাশিয়া গত বৃহস্পতিবার ভোরে ইউক্রেনে হামলা করার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই কয়েকবার ফেসবুক লাইভে এসেছেন জেলেনস্কি। মিত্রদেশগুলোর প্রতি বারবার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন। রাশিয়ার হামলার পর পশ্চিমা মিত্রদেশের কেউ প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
রাশিয়ার আক্রমণের দ্বিতীয় দিনে গত শুক্রবার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে যখন একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা হামলা চলে, তখন জেলেনস্কি বলেন, ‘ক্ষমতাধরেরা কেবল দেখছেন একা লড়ছি আমরা।’ এ মন্তব্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ফেসবুকে। অনেকেই তাঁকে সমর্থন করে মন্তব্য করেন। গত শনিবার রুশ সেনাবাহিনী কিয়েভে ঢোকার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর জেলেনস্কিকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জেলেনস্কি বলেন, তাঁকে সরিয়ে নেওয়ার দরকার নেই। তাঁর গোলাবারুদ দরকার।
রাশিয়ার মতো এত বড় ও সামরিক শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলেনস্কি। বলেছেন, অস্ত্র ফেলে পালাবেন না। দেশকে রক্ষা করবেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো জেলেনস্কিকে ‘দারুণ যোগাযোগকারী’ বা এক্সেলেন্ট কমিউনিকেটর হিসেবে বর্ণনা করছে। তবে তাঁকে নিয়ে বিতর্কও আছে। ২০২১ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের মাধ্যমে প্যানডোরা পেপারস নামে যে নথি ফাঁস হয়েছিল, তাতে জেলেনস্কি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা করস্বর্গে গোপন কোম্পানি পরিচালনা করতেন বলে বেরিয়ে আসে। এ কোম্পানির যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদ থাকার কথা বলা হয়।
ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে, যিনি জেলেনস্কির আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৪ সালে জনবিক্ষোভের মুখে তাঁর নেতৃত্বাধীন রাশিয়াপন্থী সরকারকে উৎখাত করা হয়। ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে যান। জেলেনস্কি পালাননি। তিনি পরিণত হয়েছেন ইউক্রেনের প্রতিরোধের নেতৃত্বদানকারীতে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, টুইটার, গুগল ট্রেন্ডস, রয়টার্স, এএফপি