শিরোনাম
সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিনান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) হলো ব্রাসেলসভিত্তিক আন্তঃব্যাংক আর্থিক লেনদেনের বার্তা প্রেরণের একটি সুরক্ষিত নেটওয়ার্ক। ইউক্রেনে হামলা বন্ধ না হলে সুইফটের লেনদেনে নিষিদ্ধ হতে পারে রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রগুলোর নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যাংকিং সেক্টরে ৮০ শতাংশ সম্পদ জব্দ করার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপান রাশিয়ার ব্যাংকিং খাতে প্রায় ৮০ শতাংশ সম্পদ জব্দ এবং নিষেধাজ্ঞার বাড়তি সতর্কতা দিয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্যিক অর্থপ্রদানের জন্য মূল নেটওয়ার্কের বাইরে দেশটিকে আটকানোর বিকল্পটি এটি।
এই পদক্ষেপের কারণে উচ্চ-প্রযুক্তি এবং দ্বৈত-ব্যবহারিক পণ্য রপ্তানিতে বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়বে রাশিয়া। চীনের হুয়াওয়ে টেকনোলজির বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের ২০২০ সালের পদক্ষেপের মতো আমেরিকান প্রযুক্তিতে তৈরি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে রাশিয়ার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্ব অর্থনীতির অংশ হতে ডলার, ইউরো, পাউন্ড এবং ইয়েনে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার ক্ষমতাকে সীমিত করে ফেলবে।
কিন্তু মস্কোর কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এখন প্রশ্ন উত্থাপন হতে পারে যে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে এরপর কি পদক্ষেপ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সমমনা দেশগুলো। তাহলে কি সুইফট মেসেজিং নেটওয়ার্ক থেকে বাদ পড়বে রাশিয়া?
স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মায়ার এ ধরনের পদক্ষেপকে ‘আর্থিক পারমাণবিক অস্ত্র’ বলে অভিহিত করেছেন।
লন্ডন রিসার্চ সেন্টারের ডাইওয়া ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ইয়াসুও সুগেনো বলেছেন, নিষেধাজ্ঞা আরো কঠোর করার সুযোগ এখনও আছে।
এরই মধ্যে আমেরিকার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে রাশিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এসবের মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাংক, এসবার, যার একশ মিলিয়ন বা ১০ কোটি গ্রাহক রয়েছে। এছাড়া ভিটিবি ব্যাংক, যেটি সামরিক সেক্টরের সব লেনদেন সম্পন্ন করে থাকে।
জাপানের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ব্যাংক ভিইবিআরএফ, রাষ্ট্রসমর্থিত ব্যাংক, প্রোমসভে, যা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতে অর্থায়ন করে এবং ব্যাংক রোসিয়া, যার জাপানের সঙ্গে লেনদেন রয়েছে। যুক্তরাজ্যও দেশটির সব ব্যাংকিং ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আনছে।
মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের তথ্যমতে, রাশিয়ান ব্যাংকগুলো প্রতিদিন প্রায় ৪৬ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন করে, যার ৮০ শতাংশ ডলারে চিহ্নিত করা হয়। এসবার ব্যাংক এবং ভিটিবি ডলারে লেনদেন করতে কঠোর বিধিনিষেধের মুখে পড়বে। রাশিয়া আর আমেরিকান ব্যাংকের মাধ্যমে ইউরোপীয় এবং জাপানি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডলারে লেনদেন করতে পারবে না।
জাপানের শীর্ষ এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়াকে বাণিজ্যিক অর্থপ্রদানের জন্য অন্যান্য উপায় খুঁজে বের করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না এমন ছোট আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য সুইচ উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
রাশিয়ার ওপর এসব নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হলো ব্যক্তি এবং ব্যবসার অন্যান্য মুদ্রায় প্রবেশাধিকার সীমিত করা। রুবলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং এর ফলে রাশিয়ান অর্থনীতি বাধাগ্রস্ত হবে। একটি দুর্বল মুদ্রা আমদানিকে ব্যয়বহুল করে তোলে, মুদ্রাস্ফীতিকে ত্বরান্বিত করে, যা ইতিমধ্যে রাশিয়ায় ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। বৃহস্পতিবারও ( ২৪ ফেব্রুয়ারি) রুবল ডলারের বিপরীতে সর্বকালের সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের তথ্য বলছে, ওয়াশিংটনের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রতিরক্ষা, মহাকাশ এবং সামুদ্রিক খাতগুলোকে লক্ষ্য করে দেওয়ার হচ্ছে। যেখানে সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ শিল্প, টেলিকমিউনিকেশন এবং অ্যাভিওনিক্সের (বিমানের উড্ডয়ন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ককপিট যন্ত্রাংশ,নেভিগেশন, রাডার ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, অ্যাভিওনিক্সের আওতায় পড়ে) মতো পণ্য রপ্তানির জন্য অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
মার্কিন বাণিজ্যিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাগুলোর বেশিরভাগই বহির্মুখী। সাধারণত অন্যান্য দেশের মধ্যে লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় যদি পণ্যগুলোতে মূল্য অনুসারে ২৫ শতাংশ আমেরিকান সামগ্রী থাকে।
তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র রাষ্ট্রদের নিষেধাজ্ঞাগুলো বেশিরভাগই রাশিয়ার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।
জাপানও স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) একই ধরনের নিষেধাজ্ঞা এনেছে রাশিয়ায় উচ্চ প্রযুক্তির পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে। যদিও সেই নিষেধাজ্ঞাগুলোর সুযোগ সম্পর্কে অনেক কিছুই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তবে আগামী মার্চ মাসে প্রাসঙ্গিক নিয়মগুলো সংশোধন করে প্রকাশ করা হবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং জাপানের এখনও আরও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাপানের নিষেধাজ্ঞাগুলো এসবার ব্যাংক বা ভিটিবি কে লক্ষ্য করে নয়। আবার ছোট ব্যাংকগুলোও আমেরিকান নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকছে৷ সুইফটের লেনেদেনের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা থাকলেও এখনো আলোচনা পথ খোলা রয়েছে, বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
জার্মান অর্থমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান লিন্ডনার স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সাংবাদিকদের বলেন, আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব, তবে সেগুলোর প্রভাব বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
তবে রাশিয়ার কাছে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর উপায় রয়েছে, বলছে দেশটির সেন্ট্রাল ব্যাংক।
রাশিয়ার আন্তর্জাতিক রিজার্ভ অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যার বেশিরভাগ আয় স্বর্ণ থেকে আসে এখন দাঁড়িয়েছে ৬৩০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৪ সালের চেয়ে এর পরিমাণ ৬০ শতাংশ বেশি, যখন দেশটি ক্রিমিয়া দখলের কারণে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছিল এবং এটি প্রায় দুই বছরের আমদানির সমান।
রাশিয়া ডলারে কম বাণিজ্য পরিচালনা করছে। ইউএস কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের মতে, ব্রিকস হলো পাঁচটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত রূপ যা ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত। ব্রিকস সদস্যরা আঞ্চলিক বিষয়ে তাদের উল্লেখযোগ্য প্রভাবের জন্য ডলারে চালান করে থাকে। এটির ওপর ২০১৩ সালে প্রায় ৯৫ শতাংশ থেকে ২০২০ সালে ১০ শতাংশ বা তার বেশি কমেছে রাশিয়ার নির্ভরতা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়াশিংটনের রাশিয়ার ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা অনেকাংশে নির্ভর করবে চীন তার সাথে ভূমিকা রাখবে কিনা তার উপর। আমেরিকান প্রযুক্তিতে তৈরি পণ্যগুলোতে নিষেধাজ্ঞা প্রসারিত করার বিধানটি বেইজিংকে মাথায় রেখে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, কারণ জাপান এবং ইউরোপকে ছাড় দেওয়া হয়েছে এতে।
চীনা কোম্পানিগুলো এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করবে এবং রাশিয়ায় অর্থপ্রবাহ ঠিক রাখতে নিষিদ্ধ রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে একটি কৌশল বেছে নেবে কিনা তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
সূত্র: নিক্কেই এশিয়া