ইউক্রেন সংকট ও এর সম্ভাব্য প্রভাব

ফানাম নিউজ
  ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:২০

ইউক্রেনের বর্তমান সংকটের শিকড় অনেক গভীরে এবং তা অবশ্যই ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মধ্য ইউরোপে তার কৌশলগত অবস্থানের জন্য ইউক্রেনকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পুনর্গঠন প্রচেষ্টার প্রধান কৌশল হিসাবে বেছে নিয়েছেন।

বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার, শক্তি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার কৌশল ও পরিকল্পনার অংশ হলো ইউক্রেনের ওপর প্রভাব বিস্তার করা। পুতিন ইউরোপের দিক থেকে হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইছিলেন। কারণ গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বেশির ভাগ ন্যাটো মিত্র ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব খর্ব করার চেষ্টা করেছে।

এ প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, পুতিন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অভিপ্রায় প্রকাশ করছেন একটি রুশ আধিপত্যাধীন বিস্তৃত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার, যা হবে সোভিয়েত যুগের মস্কোর শক্তির মতো। এখন ৬৯ বছর বয়সে এবং সম্ভবত তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের গোধূলিলগ্নে তিনি স্পষ্টতই রাশিয়ার ‘কক্ষপথে’ ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষের দেশ ইউক্রেনকে সংযুক্ত করতে চান। বস্তুত পুতিন ইউক্রেনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে একটি অঞ্চল হিসাবে দেখেন।

বর্তমান সংকটের পটভূমি ও প্রেক্ষাপট রচিত হয় ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর। দেশে ও বিদেশে পুতিনের প্রায় সব পদক্ষেপের মূলে রয়েছে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। তিনি যেন চার শতাব্দীর পুরোনো রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে চান। পুতিন সোভিয়েতের ভাঙনকে একটি বিপর্যয় হিসাবে মনে করেন, যা রাশিয়ার পরাশক্তির স্থান কেড়ে নিয়েছিল। তিনি ২২ বছর ক্ষমতায় কাটিয়েছেন রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পুনর্গঠন এবং এর ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে।

পুতিন দাবি করেন, ইউক্রেন ও বেলারুশ মৌলিকভাবে, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার অংশ। এ সংকটের অন্য কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইইউর উদ্যোগে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং ২০০৮ সালে ন্যাটোর বুখারেস্ট সম্মেলনে ইউক্রেনের জন্য একটি সদস্যপদের অ্যাকশন প্ল্যান (MAP)। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে-যুক্তরাষ্ট্রের এবিএম চুক্তি বাতিল; ইউক্রেন, জর্জিয়া ও অন্যত্র সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানে সমর্থন; ইউক্রেনের সঙ্গে একটি অ্যাসোসিয়েশন চুক্তির জন্য ইইউর পরিকল্পনা এবং ইউরোমাইডান বিক্ষোভে সমর্থন প্রদান, যা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল।

রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর মধ্যে আস্থা ভেঙে যাওয়ার কারণগুলো ইউক্রেন সংকটের আরেকটি কারণ। রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে আস্থার ক্ষয় শুরু হয়েছিল ১৯৯০ সালে জার্মানির একীভূতকরণের সময় দেওয়া মার্কিন ও পশ্চিমা নেতৃত্বের প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের পর।

তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-ন্যাটোর পূর্বমুখী কোনো সম্প্রসারণ হবে না। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর ন্যাটো পূর্বদিকে প্রসারিত হয় এবং একসময়ের কমিউনিস্ট বলয়ে থাকা বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশ ন্যাটোতে যোগ দেয়। বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এ দেশগুলো পোল্যান্ড, রোমানিয়া এবং পূর্ব ইউরোপীয় অন্য দেশগুলোর মতো ন্যাটোতে যোগদান করে।

পরিকল্পনা ছিল ইউক্রেনকেও ন্যাটোভুক্ত করার। রুশ প্রেসিডেন্ট ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ এবং এ সামরিক জোটে ইউক্রেনের যোগদানের সম্ভাবনাকে তার দেশের জন্য একটি অস্তিত্বের হুমকি হিসাবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে ইউক্রেন সরকার প্রকাশ্যে বলেছে, তারা ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করবে এবং ন্যাটোভুক্ত হওয়ার উচ্চাকাক্সক্ষাও তাদের রয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে ইউক্রেন সংকটের শুরু ১৯৫৪ সালে যখন সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ রাশিয়া-ইউক্রেন একীভূত হওয়ার ৩০০তম বার্ষিকী উদ্যাপনকালে রুশ সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিক থেকে ইউক্রেনীয় সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল রিপাবলিকের কাছে ক্রিমিয়াকে হস্তান্তর করেন। যেহেতু উভয় প্রজাতন্ত্রই সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ছিল, তাই এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর সদ্য স্বাধীন ইউক্রেনে ক্রিমিয়ার অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তাছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বৃহত্তর অর্থনৈতিক একীকরণের জন্য একটি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করার ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নভেম্বর ২০১৩ সালে রাজধানী কিয়েভে বিক্ষোভের মাধ্যমে ইউক্রেনের মূল সংকট শুরু হয়।

বিক্ষোভের মধ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। গণভোটে ক্রিমিয়ানরা রাশিয়ান ফেডারেশনে যোগদানের জন্য ভোট দেয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রিমিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনের রুশ নাগরিক এবং রুশ ভাষাভাষীদের অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এ সংকটটি জাতিগত বিভাজন বাড়িয়ে তোলে এবং দুই মাস পর পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়াপন্থি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউক্রেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য একটি গণভোট আয়োজন করে।

পূর্ব ইউক্রেনে রুশসমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনী এবং ইউক্রেন সেনাবাহিনীর মধ্যে সহিংসতায় এপ্রিল ২০১৪ থেকে এ পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত এবং প্রায় ২৪ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। জুলাই ২০১৪ সালে ইউক্রেনের পরিস্থিতি একটি আন্তর্জাতিক সংকটে রূপ নেয়। এ সময় ইউক্রেনের আকাশসীমায় মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজকে গুলি করা হলে ২৯৮ জন আরোহীর সবাই নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে।

২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ইউক্রেনের কাছে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেয়। অক্টোবর ২০১৮-এ পশ্চিম ইউক্রেনে বৃহৎ আকারের বিমান মহড়ায় অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো, যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া।

২০২১ সালের অক্টোবরে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তের কাছে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন শুরু করে। ডিসেম্বরে এক লাখেরও বেশি সৈন্য সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সতর্ক করেছিলেন, রাশিয়া ২০২২ সালের প্রথম দিকে ইউক্রেন আক্রমণের পরিকল্পনা করছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু দাবি উত্থাপন করে, যার মধ্যে রয়েছে-ইউক্রেনের উত্তরে ন্যাটোর প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এবং পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম হ্রাস করা, ইউক্রেন কখনই ন্যাটোতে যোগদান করবে না, যেসব পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ইতোমধ্যে ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে, সেসব দেশে তাদের বাহিনী অপসারণ করবে এবং ইউক্রেনে ২০১৫ সালের যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ন্যাটো মিত্ররা এ দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করে এবং রাশিয়াকে সতর্ক করে দেয়।

ফেব্রুয়ারির শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন ন্যাটোভুক্ত দেশ পোল্যান্ড ও রোমানিয়ার সীমান্তে প্রায় তিন হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ও বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র পাঠায়, রাশিয়ার সীমান্তবর্তী ন্যাটো দেশগুলোয় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি বাড়ায় এবং পূর্ব ইউরোপে মোতায়েনের জন্য ৮৫০০ সৈন্যকে উচ্চ সতর্কতায় রাখে।

ইউক্রেন সংকট বিশ্ব অর্থনীতিতে ঝড় তুলেছে। এ সংকট জি-৭ দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের একটি যৌথ বিবৃতি জারি করতে প্ররোচিত করে-‘যদি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে, তাহলে তার জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে।’

তবে এর ফলে প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইউরোপে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। রাশিয়া বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎপাদক। দেশটি তার উৎপাদনের ৩৫ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি করে এবং এর প্রায় ৭০ শতাংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে পাঠায়, যার বেশিরভাগই ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় পাইপলাইনটি হলো নর্ড স্ট্রিম ১, যার ক্ষমতা বার্ষিক ৫৫ বিলিয়ন ঘনমিটার।

রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়া থেকে জার্মানিতে প্রাকৃতিক গ্যাস স্থানান্তর করার জন্য নবনির্মিত ১০ বিলিয়ন ডলারের নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস ইতোমধ্যেই তা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।

শুধু গ্যাস নয়, জার্মানির কয়লা আমদানির অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করে রাশিয়া। রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে বিশ্ববাজারে তেলের দামের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে ইউরোপীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাবে, যা তেলের দামকে প্রভাবিত করবে। রাশিয়া বিরল খনিজ ও ভারী ধাতুগুলোর একটি প্রধান রপ্তানিকারক, যেমন বিমানে ব্যবহৃত টাইটানিয়াম।

রাশিয়া বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্যালাডিয়াম সরবরাহ করে। তাছাড়া ইউক্রেন সংকট ইউক্রেনীয় শিল্প উৎপাদনও ব্যাহত করবে। ইউক্রেন নিয়নের একটি প্রধান উৎস, যা সেমিকন্ডাক্টর তৈরিতে ব্যবহার হয়। ফলস্বরূপ, মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর এবং মহাকাশ শিল্পসহ বিভিন্ন সেক্টরে সাপ্লাই চেইন বিঘ্নিত হবে। ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয় দেশেই প্রচুর পরিমাণে সার উৎপাদিত হয়।

এর রপ্তানিতে বাধা ইউরোপের কৃষিকে প্রভাবিত করবে, ফলে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক অস্থিতিশীলতার ধাক্কা বিশ্ববাজারে আঘাত করতে পারে। নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বোচ্চ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সূত্র: যুগান্তর