অভিনেত্রী-মডেলদের রিমান্ড-জামিনে সরগরম ছিল আদালতপাড়া

ফানাম নিউজ
  ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ১০:০৯

সময়ের চক্রে শেষ হলো আরও একটি বছর, ২০২১ সাল। বছরটি ছিল নানা ঘটনা ও বিতর্কের নীরব সাক্ষী। বিশেষত তারকা অঙ্গনের বেশ কিছু মডেল-অভিনেত্রীর নানা কর্মকাণ্ডে শোরগোল ছিল পুরো বছর। নামিদামি অভিনেত্রী-মডেলদের আনাগোনায় সরগরম ছিল আদালতপাড়া। কখনো চিত্রনায়িকা পরীমনি বা একা আবার কখনো মডেল পিয়াসা ও মৌদের নানা ঘটনায় উত্তপ্ত ছিল আদালতপ্রাঙ্গণ। তাদের রিমান্ড ও জামিন শুনানি নিয়ে প্রায় পুরোটা বছরই মানুষের চোখ ছিল আদালতের ওপর।

বিদায়ী বছরে ঢাকার আদালতে যেসব আলোচিত মামলা ও মামলার রায় হয়েছে, তা নিয়েই পাঁচ পর্বের সালতামামির আজ পড়ুন তৃতীয় পর্ব।

প্রথমে পরীমনি ভুক্তভোগী, পরে মাদক মামলার আসামি

ঢাকাই সিনেমার নায়িকা পরীমনি ২০২১ সালে তারকা অঙ্গনে ছিলেন আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে। চলতি বছরের ৮ জুন রাতে মারধর, বিভিন্ন ধরনের হুমকি ও যৌন হয়রানির অভিযোগ তোলেন নায়িকা। এ ঘটনায় ১৪ জুন ব্যবসায়ী নাসির উদ্দিন মাহমুদ ও তুহিন সিদ্দিকী অমির নামোল্লেখ করে এবং চারজনকে অজ্ঞাত আসামি করে সাভার থানায় মামলা করেন তিনি। এ মামলায় নাসির ও অমিকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পরদিন (১৫ জুন) সাভার থানার পুলিশ পরিদর্শক কামাল হোসেন এ দুজনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। নাসির ও অমি মাদক মামলায় রিমান্ডে থাকায় ওইদিন রিমান্ড শুনানি হয়নি। মাদক মামলায় রিমান্ড শেষে তাদের আদালতে হাজির করা হয়।

এরপর পরীমনিকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টা মামলায় পুলিশের করা ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন বিচারক। গত ২৩ জুন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাজীব হাসান শুনানি শেষে নাসির-অমির পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ড শেষে ২৯ জুন তাদের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুই আসামিকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জামিন আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাদী তাহমীদা আসামিদের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। পরীমনির করা এ মামলার তদন্ত শেষে গত ৬ সেপ্টেম্বর তদন্তকারী কর্মকর্তা কামাল হোসেন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। আলোচিত এ মামলার অপর আসামি শহিদুল আলম পলাতক রয়েছেন।

ওই মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই চলতি বছরের ৪ আগস্ট বিকেলে পরীমনির বনানীর বাসায় দীর্ঘ চার ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে র‌্যাব। পরে রাত ৮টার দিকে নেওয়া হয় র‌্যাব সদরদপ্তরে। অভিযানে নায়িকার বাসা থেকে নতুন মাদক এলএসডি, মদ ও আইস উদ্ধার করা হয়। বাসার ড্রয়িংরুমের কাভার্ড, শোকেস, ডাইনিংরুম, বেডরুমের সাইড টেবিল ও টয়লেট থেকে বিপুল মদের বোতল উদ্ধার করা হয়। পরদিন ৫ আগস্ট র‌্যাব বাদী হয়ে বনানী থানায় পরীমনি ও তার সহযোগী আশরাফুল ইসলাম বিপুর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে।

সারাদেশে ব্যাপক আলোচনায় আসা এ মামলায় পরীমনিকে তিন দফায় মোট সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত তাকে জামিন দেন। মামলার তদন্তকাজ শেষে গত ৪ অক্টোবর তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক কাজী মোস্তফা কামাল আদালতে পরীমনিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন। আগামী ২ জানুয়ারি আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

মাদককাণ্ডে গ্রেফতার প্রযোজক-অভিনেতা রাজ

পরীমনিকে আটকের রাতেই (গত ৪ আগস্ট) চলচ্চিত্র প্রযোজক ও অভিনেতা নজরুল ইসলাম রাজের বনানীর বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। পরীমনিকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে চালানো এ অভিযানে রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজকে আটক করা হয়। তার বাসা থেকেও মাদক ও পর্নোগ্রাফি তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের কথা জানায় র‌্যাব।

পরদিন ৫ আগস্ট রাজের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও পর্নোগ্রাফি আইনে পৃথক দুটি মামলা করে র‌্যাব।
ওইদিনই তার চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালত। রিমান্ড শেষে ১০ আগস্ট আদালতে তোলা হলে ঢাকা মহানগর হাকিম দেবব্রত বিশ্বাস মাদক মামলায় দুদিন ও পর্নোগ্রাফি মামলায় আরও চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মাদক মামলার তদন্তকাজ শেষে রাজের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী সংস্থা। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন। রাজও আছেন কারাগারে।

প্রতারণার মামলায় গ্রেফতার অভিনেত্রী স্বর্ণা

প্রথমে বিয়ের প্রলোভন ও পরবর্তীতে বিয়ে করে প্রতারণার মাধ্যমে এক সৌদি প্রবাসীর কাছ থেকে কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়া এলাকা থেকে মডেল ও অভিনেত্রী রোমানা ইসলাম স্বর্ণাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ভুক্তভোগী সৌদি প্রবাসী ব্যবসায়ী কামরুল হাসানের করা মামলায় গ্রেফতারের পরদিন ১২ মার্চ পুলিশ রিমান্ড আবেদন করলে শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে স্বর্ণাকে জেলগেটে একদিনের জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন।

মোহাম্মদপুর থানায় ১১ মার্চ স্বর্ণার বিরুদ্ধে করা মামলায় ভুক্তভোগীর অভিযোগ, তার কাছে থেকে ব্যবসা ও ফ্ল্যাট কেনাসহ নানা অজুহাতে এক কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন স্বর্ণা।

এজাহারে বলা হয়, রোমানা ইসলামের সঙ্গে কামরুল হাসানের ২০১৮ সালে প্রথমে ফেসবুকে পরিচয় হয়। পরে তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্বের সূত্র ধরে কামরুলের কাছ থেকে গাড়ি কেনার জন্য টাকা নেন রোমানা। কামরুল দেশে ফেরার পর ২০২০ সালে ফাঁদ পেতে রোমানা তাকে বিয়েও করেন এবং তার কাছ থেকে ফ্ল্যাট কেনার টাকাও নেন। পরে চাপে ফেলে কামরুলের কাছ থেকে তালাক নেন। পরবর্তীতে কামরুল সৌদি চলে যান। এরপর দেশে তার টাকায় কেনা গাড়ি ও ফ্ল্যাট ফেরত চাইলে রোমানা তার সহযোগীদের নিয়ে কামরুলকে হত্যার হুমকি দেন। এ মামলায় গত মে মাসের মাঝামাঝি জামিনে মুক্তি পান অভিনেত্রী রোমানা স্বর্ণা।

গৃহকর্মী নির্যাতন ও মাদক মামলায় গ্রেফতার অভিনেত্রী একা

রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় গৃহকর্মীকে হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা পৃথক দুটি মামলায় গত ৩১ জুলাই চিত্রনায়িকা একাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার বাসায় অভিযান চালিয়ে পাঁচটি ইয়াবা বড়ি, গাঁজা ও মদ উদ্ধার করা হয়। পরদিন ১ আগস্ট এ দুই মামলায় তাকে আদালতে হাজির করে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য দুই মামলায় তিনদিন করে ছয় দিনের রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক মো. ফয়সাল। এসময় আসামিপক্ষের আইনজীবী রিমান্ড বাতিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড ও জামিন নাকচ করে একাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এরপর গত ১০ আগস্ট মাদক মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম আতিকুল ইসলামের ভার্চুয়াল আদালত এক হাজার টাকা মুচলেকায় একার জামিন মঞ্জুর করেন। গত ২২ আগস্ট গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশীদের আদালতে জামিন পান নায়িকা। দুই মামলায় জামিন নিয়ে গত ২৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান এ চিত্রনায়িকা।

মাদক মামলায় গ্রেফতার মডেল পিয়াসা

রাজধানীর গুলশানের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি মদ ও ইয়াবা উদ্ধারসহ আলোচিত-সমালোচিত মডেল ফারিয়া মাহাবুব ওরফে পিয়াসাকে গত ১ আগস্ট রাতে গ্রেফতার করে পুলিশ (ডিবি)। ওই রাতেই তাকে নেওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। পরে তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃথক তিনটি মামলা হয়। অস্ত্র আইনের একটি এবং মুনিয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে আরেক মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এসব মামলায় তাকে একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয়। এর মধ্যে মাদকের তিনটি ও অস্ত্র আইনের একটি মামলায় মডেল পিয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্তকারী সংস্থা। বর্তমানে তিনি কারাগারে।

গুলশান থানায় করা মাদক মামলার অভিযোগপত্রে সিআইডি বলছে, পিয়াসা মডেলিং পেশার আড়ালে নিয়মিত ক্লাবে যেতেন এবং ক্লাব থেকে টাকার বিনিময়ে নিয়মিত মদ সংগ্রহ করতেন। পরে এসব মাদকদ্রব্য তিনি ক্লাব ও বাসায় বিভিন্ন পার্টিতে আসা লোকজনের কাছে বিক্রি করতেন। তবে পিয়াসা কোন ক্লাব থেকে, কার কাছ থেকে কিংবা কী ধরনের মাদকদ্রব্য সংগ্রহ করেছিলেন, সে ব্যাপারে অভিযোগপত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই।

মাদক মামলায় গ্রেফতার মডেল মৌ

পিয়াসার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুরে বাবর রোডের ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে গত ১ আগস্ট রাত ১টার দিকে আরেক মডেল মরিয়ম আক্তার মৌকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। অভিযানে তার বাসার ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ৭৫০ পিস ইয়াবা ও ১২ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করে পুলিশ।

এ ঘটনায় মৌয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর দুই থানায় পৃথক দুটি মামলা হয়। দুই মামলায় রিমান্ডে নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। পরে উভয় মামলা জামিনে মুক্তি পান তিনি। তবে তদন্ত শেষে দুই মামলায় এ মডেলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে সিআইডি।

সূত্র: জাগো নিউজ