শিরোনাম
বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার মহান কারিগর মহানায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার ৩৮ বসন্ত কাটিয়ে ৩৯ বছরে পা পড়ল। কাকতালীয়ভাবে একই দিনে মাশরাফির সঙ্গে তার ছেলে সাহেলেরও জন্মদিন।
১৯৮৩ সালের ৫ অক্টোবর রাত ৮টায় নড়াইলের চিত্রা নদীরপারে মহিষখোলা গ্রামে নানার বাড়িতে জন্মেছিলেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার মাশরাফি। মাতামহ ডাকনাম রাখলেন কৌশিক। তিনি নড়াইলে কৌশিক নামেই সমধিক পরিচিত। নানির কাছেই শিশু কৌশিক লালিত হতে থাকেন। সেই থেকে আজও কৌশিককে নানার বাড়িতেই আটকে রেখেছে। এখনো মামাবাড়ির প্রতি ঝোঁক কাটেনি তার। মা বলাকা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া ছেলেকে কাছে পান না। নানি-মামাদের কোলে-পিঠে চড়েই বড় হয়েছেন কৌশিক। মাশরাফির পিতা গোলাম মুর্তজা ও মাতা হামিদা মুর্তজা। ডাকনাম স্বপন ও বলাকা।
নড়াইলের চিত্রাপারের আরেক বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বিপ্লব-সংগ্রাম ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে থাকার ইতিহাস তার শিল্পকর্মকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। অনুরূপভাবে, চিত্রাপারের অপর ছেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দলের অপরিহার্য হয়ে ওঠা মাশরাফির একমাত্র শত্রু ছিল ইনজুরি। আর এই ইনজুরির সঙ্গে লড়তে লড়তেই আরও দুঃসাহসী যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন তিনি। পরিস্থিতি যত খারাপই হোক তাকে টলাতে পারেনি, ব্যাকফুটে থাকলেও সেখান থেকে লড়াই করে নিজেকে প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জটাই পছন্দনীয় ‘লড়াকু’ মাশরাফির। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত সাবেক টাইগার সেনাপতি মাশরাফি। শৈশব কেটেছে চিত্রা নদীর পারে। ছোটবেলায় বন্ধুদের সর্দার (দলনেতা) ছিল কৌশিক। তার সঙ্গে চিত্রা নদীর এক ধরনের মিতালী ছিল। এই নদী তাকে খুব টানত। নড়াইলের সঙ্গে রয়েছে মাশরাফির নাড়ির টান। তাই তো হাজার ব্যস্ততার মাঝে সুযোগ পেলেই বারবার নড়াইলে ছুটে আসেন তিনি।
নড়াইলে মাশরাফির বেড়ে ওঠার পথ বড়ই রোমাঞ্চকর। কৈশোরিক দুরন্তপনা, প্রবল মানসিক দৃঢ়তা, ব্যতিক্রমী লড়াকু চরিত্রের কারণে তিনি অনুসরণীয় সবার কাছে। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত টাইগার সেনাপতি মাশরাফি। শৈশব কেটেছে চিত্রাপারে। মাশরাফি সহজেই মানুষের মন কেড়ে নিতে পারে। খুব সহজ-সরল একেবারেই মাটির মানুষ। ক্রিকেটে অনিয়মিত হলেও অবসরের ঘোষণা দেননি মাশরাফি। তবে খেলার মাঠ ছেড়ে রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় তিনি। ক্রিকেটের সবুজ গালিচায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বকালের সফল ওয়ান ডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা। মাঠের খেলায় জয়ী অধিনায়ক এবার তার নেতৃত্বের গুণ দেখালেন রাজনীতির মাঠেও।
রাজনীতির ময়দানেও ক্রিকেটের মতই সফল ও এবং সমান জনপ্রিয় এই অধিনায়ক। ক্রিকেট মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠে উঠে আসা জাতীয় দলের এই তারকা খেলোয়াড় গত একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নড়াইল-২ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। জনহিতৈষী কর্মকাণ্ডে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। মাশরাফির বাবা স্বপন ছিলেন ফুটবলার ও অ্যাথলেট। যদিও তিনি চাইতেন না ছেলে ক্রিকেট খেলুক। তবে মাশরাফির মা স্কুলশিক্ষিকা হামিদা মুর্তজা চাইতেন মাশরাফির সব ইচ্ছা পূরণ করতে। তিনিই ক্রিকেট খেলার সামগ্রী কেনার টাকা দিতেন মাশরাফিকে।
মাশরাফির শিক্ষাজীবন শুরু হয় নড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নড়াইল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০১ সালে এসএসসি পাস করেন। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর দর্শন শাস্ত্রে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্রীড়াঙ্গনে তিনি ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের এ যাবতকালের সেরা পেসার তিনি। চিত্রা নদীই ছিল কৌশিকের ঘর, চিত্রাই তার বাড়ি। নদীতে সাঁতার কেটে তার আনন্দ যেন অন্য কিছুতে হতো না। নদী যেন তার পোষ মানা কেউ। একই রকম দখল বৃক্ষরাজির ওপর। আম-জাম-লিচু-নারকেল সব গাছেই তার শাখামৃগের আদলে বিচরণ। সেই দুরন্ত কিশোরটিই আজকের মাশরাফি।
নব্বইয়ের দশকে নড়াইলের ক্রিকেটার-সংগঠক শরীফ মোহাম্মদ হোসেন উঠতি তরুণদের যত্ন নিতেন। তিনি ১৯৯১ সালের দিকে মাগুরায় বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পের বিকেএসপি কোচ বাপ্পির সান্নিধ্যে এসে বোলিংয়ের অনেক মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। পরের বছর জাতীয় কোচ ওসমান খান নড়াইলে এক প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালাচ্ছিলেন। ওই সময় কৌশিকের আমন্ত্রণ আসে খুলনায় খেলার জন্য। খুলনায় তার গতি ও সুইং হইচই ফেলে দেয়। সেই সূত্রে খুলনা বিভাগীয় অনূর্ধ্ব-১৭ দলে সুযোগ, ঢাকায় আসা এবং আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
এভাবেই একদিন সুযোগ পেয়ে গেলেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। সেখান থেকেই তিনি চোখে পড়েন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলিং কোচ অ্যান্ডি রবার্টসের। তার হাতে পড়েই ক্যারিয়ার বদলে যায় মাশরাফির। যে কারণে তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি প্রথম শ্রেণির কোনো ম্যাচ না খেলেই টেস্টে অভিষিক্ত হন। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকেই নিয়েছিলেন ৪ উইকেট। একই বছর ২৩ নভেম্বর ওয়ানডে ক্রিকেটে মাশরাফির অভিষেক হয়। অভিষেক ম্যাচে মোহাম্মদ শরীফের সঙ্গে বোলিং ওপেন করে তিনি ৮.২ ওভারে ২৬ রান দিয়ে নেন ২টি উইকেট। সেই থেকেই শুরু পথচলা।
প্রায় ২০ বছর যাবত দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। দুই পায়ে সাতটি অস্ত্রোপচার। তবে এসব ইনজুরির দোহাই দিয়ে দলে টিকে ছিলেন না। বল হাতে, অধিনায়ক হিসেবে পারফর্ম করেছিলেন বলেই টিকে ছিলেন। গত বছর ৬ মার্চে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিলেও অবসর নেননি মাশরাফি। ২০১০ সালে দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব বুঝে পেয়েছিলেন মাশরাফি। কিন্তু হাঁটুর চোট তাকে সেই দায়িত্ব পালন করতে দেয়নি। টানা ব্যর্থতায় ভঙ্গুর একটা দলের ভার মাশরাফির কাঁধে তুলে দিয়েছিল বিসিবি। ২০১৪ সালে দলের ভীষণ দুঃসময়ে অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে তিনি বদলে দেন জাতীয় দলকে।
২০১৫ সালে বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, ২০১৭ সালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল আর পরের বছর এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ খেলেছে মাশরাফির নেতৃত্বে। পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান-দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয় তো আছেই। মাশরাফি শেষ পর্যন্ত ৮৮ ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে জয়ের হাফসেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের হয়ে মাশরাফি শিকার করেছেন ২৬৯টি উইকেট। ফলে এ সময়ে নেতৃত্বের পাশাপাশি বোলার মাশরাফিও ছিলেন সমানভাবে উজ্জ্বল।
৩৮ বছরের মাশরাফি আর কত দিবে দেশের ক্রিকেটকে। এ ধরনের মানুষেরা ক্ষণজন্মা। চিত্রা নদীপারের যে পেশিবহুল কৃষক-জেলেদের চিত্রকথা বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান এঁকেছেন, মাশরাফি বোধ করি তাদেরই একজন। ইংল্যান্ডের সাবেক ক্যাপ্টেন নাসের হোসাইন বলেছিলেন, ‘নেতা, মানুষ আর খেলোয়াড়- এ তিনটি শব্দ যোগ করে মাশরাফি এমন একজন ক্রিকেটার, যা এর আগে কোনো দিন ক্রিকেটবিশ্ব দেখেনি।’
এ পোড়া ভূখণ্ড মানবিক মুগ্ধতা জাগানিয়া জেদি আর আত্মগর্বী এ মানুষটির ভাঙা হাঁটুকে স্যালুট জানাতে গিয়ে নতজানু হই বারবার। বলি আপনি বারবার পুনর্জন্ম নিয়ে জীবনানন্দের মতো ফিরে আসুন এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।