মেট্রোরেল: জাইকা থেকে আরও ৩০৮১ কোটি টাকা ঋণ চায় সরকার

ফানাম নিউজ
  ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৪৭

**প্রথমে অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি
**সংশোধন প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি
**জাইকার ঋণ ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি, সরকারের ব্যয় ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি

যানজট থেকে ঢাকাবাসীকে মুক্তি দিতে দ্রুত এগিয়ে চলছে দেশের প্রথম মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের কাজ। এই প্রকল্পের উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার অংশের কাজ বলতে গেলে শেষ। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে এই অংশে মেট্রোরেল চলাচল উদ্বোধন করা হবে। কাজ চলছে প্রকল্পের বাকি অংশেও।

প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। অনুমোদিত ব্যয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। তবে মতিঝিল ছাড়িয়ে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত নেওয়ায় প্রকল্পের কাজ বেড়ে গেছে। মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার ধরে মেট্রোরেলের রুট দাঁড়াচ্ছে ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার। কাজ বাড়ার কারণে বেড়েছে ব্যয়ও। সেজন্য বর্তমান উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সেখানে ডিপিপির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পে নতুন ব্যয় ১১ হাজার ৪৮৬ কোটি ৯২ লাখ টাকা বাড়ছে।

আগের প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুসারে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকাই ছিল জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার ঋণের। বাকি টাকা সরকারি তহবিলের। নতুন করে যে ব্যয় বাড়ছে, সেখানে যোগানের জন্য জাইকা থেকে ঋণ চাওয়া হবে আরও তিন হাজার ৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হবে আট হাজার ৪০৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা। নতুন অর্থ জাইকা দিলে তাদের ঋণ দাঁড়াবে ১৯ হাজার ৬৭৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। আর এ প্রকল্পে সরকারি তহবিলের ব্যয় দাঁড়াবে ১৩ হাজার ৭৯৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটির প্রাথমিক মেয়াদকাল ছিল ১ জুলাই ২০১২ থেকে ৩০ জুন ২০২৪। তবে কাজ বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্প শেষ করতে সময় লাগবে আরও এক বছর ছয় মাস। সেক্ষেত্রে এটির মেয়াদ ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র বলছে, জাইকার অনুমতি নিয়েই মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত কাজের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন ডিপিপি সংশোধন করলে জাইকা বরাবর বাড়তি ঋণের প্রস্তাব করবে ইআরডি। সংস্থাটি বাড়তি ঋণ দিতে রাজি হবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।

ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের ডিপিপি সংশোধন করা হচ্ছে। তবে এখনো পরিকল্পনা কমিশন সংশোধন চূড়ান্ত করেনি। তারা চূড়ান্তভাবে সংশোধন করলে জাইকা বরাবর বাড়তি ঋণের প্রস্তাব করা হবে। জাইকা খুবই উদার। আমার মনে হয় তাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালে সেটা গ্রহণ করবে। তবে তার আগে প্রকল্পটি সঠিকভাবে সংশোধন হয়ে আমাদের হাতে আসতে হবে।

জাইকার কাছ থেকে বাড়তি ঋণ প্রস্তাব প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের (সচিব) সদস্য মো. মামুন-আল-রশীদ বলেন, ‘সামনে প্রকল্পের পিইসি (প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি) সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় ইআরডি প্রতিনিধিও উপস্থিত থাকবেন। আমরা প্রকল্পের ডিপিপি নিয়ে মিটিং করবো। ব্যয় ও সময় বাড়ানোর বিষয়টি যৌক্তিক কি না যাচাই করবো। যদি যৌক্তিক হয় তবে ব্যয় ও সময় বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করবো। এরপর প্রকল্পে বাড়তি ঋণ চেয়ে ইআরডির মাধ্যমে জাইকা বরাবর প্রস্তাব যাবে।’

প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধনের কারণ
সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধন প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বাড়তি অংশে ভূমি অধিগ্রহণ, নির্মাণ এবং ই অ্যান্ড এম সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। পাশাপাশি ট্রানজিট অরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্টের (টিওডি) জন্য ভূমি বরাদ্দ ও নকশা তৈরি, ট্রেন পরিচালনার বিদ্যুৎ খরচ এবং এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সংগ্রহ করা হবে। এছাড়া স্টেশনে যাত্রী ওঠানামার জন্য লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি তৈরি, ফুটপাত নির্মাণ, পরামর্শক ব্যয় এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম চলবে। এসবের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়ছে।

পাশাপাশি উত্তরা সেন্টার স্টেশনকে কেন্দ্র করে একটি ট্রান্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড হাব (টিওডি) নির্মাণ, স্টেশন প্লাজাসহ বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরির জন্য নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে। এসব পরিকল্পনা অবশ্য প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে ছিল না।

মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় বাড়ার পেছনে শুল্ক ও ভ্যাট খাতকেও অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে ডিএমটিসিএল। সংস্থাটি আরও বলছে, প্রকল্প ব্যয়ের একটি বড় অংশ চলে যায় বিভিন্ন পণ্য, নির্মাণসামগ্রী ও সেবা ক্রয় বাবদ সরকারকে শুল্ক-কর দিতে গিয়ে। এর বাইরে জমি অধিগ্রহণের পেছনেও একটা বড় ব্যয় হয়। সংশোধিত ডিপিপির প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের প্রায় ২৩ শতাংশই খরচ হচ্ছে শুল্ক-কর ও জমি অধিগ্রহণ খাতে। পরামর্শক খাতেও ব্যয় বাড়বে।

ব্যয়ের নতুন খাত
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেট্রোরেলের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা সংশোধনীর ফলে পরামর্শক নিয়োগ খাতে ১৩৫ কোটি, ইউটিলিটি সংযোগ খাতে ১০ কোটি, লাইসেন্স ফি নবায়ন খাতে ১০ কোটি, ডিজিটাল আর্কাইভ সফটওয়্যার খাতে ৫০ লাখ, রোলিং স্টকস (মতিঝিল টু কমলাপুর) খাতে ৫০ কোটি ১৪ লাখ, সিভিল ওয়ার্কস (মতিঝিল টু কমলাপুর) খাতে ১১৬০ মিটার অন্তর্ভুক্তিতে ৭১৪ কোটি ৫৬ লাখ, স্টেশন প্লাজা নির্মাণে ৯২ কোটি ৮০ লাখ ও বৈদ্যুতিক বিল খাতে ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে।

প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয় ১৮ দশমিক ৭৯ হেক্টর বাড়ানো হচ্ছে। ফলে প্রকল্পকেন্দ্রিক জমির মোট পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৫ দশমিক ৭৯ হেক্টর। এ খাতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৭৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। জেনারেল পরামর্শক সেবা খাতে ১৩ হাজার ৫৪৪ জনমাস বাড়ছে, এ খাতে ব্যয় ৫৭৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বাড়ছে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সিডি ভ্যাট খাতে এক হাজার ১৭৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বাড়ছে।

মেট্রোরেলের স্টেশন সংখ্যা বেড়ে ১৭টি
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে, মেট্রোরেলের ১৬টি স্টেশন হওয়ার কথা ছিল। এখন নতুন করে কমলাপুরে একটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। স্টেশনের স্থানগুলো হচ্ছে উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল।

প্রকল্পের অগ্রগতি
প্রকল্পের সর্বশেষ অগ্রগতি প্রসঙ্গে ডিএমটিসিএল সূত্র জানায়, ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের (লাইন-৬) উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেলের সর্বশেষ সার্বিক গড় অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। প্রথম পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত উত্তরা তৃতীয় পর্ব হতে আগারগাঁও অংশের পূর্তকাজের অগ্রগতি ৯০ দশমিক ০৮ শতাংশ । দ্বিতীয় পর্যায়ে নির্মাণের জন্য নির্ধারিত আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের পূর্তকাজের অগ্রগতি ৭৩ দশমিক ০৮ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি ৭০ দশমিক ৯১ শতাংশ। ইতোমধ্যে ১০টি মেট্রো ট্রেন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে।

মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রুট আগামী ডিসেম্বর মাসে চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

সূত্র: জাগো নিউজ