শিরোনাম
নাজরানের প্রতিনিধি দলকে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, ‘তোমরা মুসলিম হয়ে যাও’। প্রিয় নবির এ কথার জবাবে তারা বলেছিল, ‘আমরাতো মুসলিমই’। কিন্তু কেউ যদি নিজেকে মুখে মুসলিম বলে পরিচয় দেয়; তবে কি সে ইসলামের অনুসারি হয়ে যায়? ‘আমরা মুসলিম’ এ দাবিতেই কি নিজেকে মুসলিম হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে? এ সম্পর্কে ইসলামের দিকনির্দেশনাই বা কী?
কোরআনুল কারিমের সুরা আল-ইমরানের ৬৫-৬৭নং আয়াতে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। নাজরানের প্রতিনিধি দলের আগে ‘ইয়াহুদি-খ্রিস্টান’রাও হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে নিয়ে এ রকম তর্ক-বিতর্ক করতো। আল্লাহ তাআলা সে প্রসঙ্গটি তুলে ধরে বিষয়টি সুস্পষ্ট করেছেন।
কথা ও কাজের বাস্তবায়ন ছাড়া শুধু মুখের কথায় বা কোনো কিছু দাবি করায় কেউ কোনো দলের একনিষ্ঠ অনুসারী হতে পারে না। নাজরানের প্রতিনিধি দলের ‘মুসলিম’ দাবির প্রসঙ্গ টেনে মহান আল্লাহ তাআলা আগের ঘটনার বিবৃতি দিয়ে এভাবে আয়াত নাজিল বলেন-
১. یٰۤاَهۡلَ الۡکِتٰبِ لِمَ تُحَآجُّوۡنَ فِیۡۤ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ مَاۤ اُنۡزِلَتِ التَّوۡرٰىۃُ وَ الۡاِنۡجِیۡلُ اِلَّا مِنۡۢ بَعۡدِهٖ ؕ اَفَلَا تَعۡقِلُوۡنَ
হে আহলে কিতাবের অনুসারীরা! (ইয়াহুদি খ্রিস্টানরা) তোমরা কেন (অযথা) ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে বিতর্ক করছ; অথচ ( তোমাদের আসমানি গ্রন্থ) তাওরাত ও ইঞ্জিল তো তার পরেই নাজিল করা হয়েছিল? তোমরা কি বুঝ না? (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৬৫)
২. هٰۤاَنۡتُمۡ هٰۤؤُلَآءِ حَاجَجۡتُمۡ فِیۡمَا لَکُمۡ بِهٖ عِلۡمٌ فَلِمَ تُحَآجُّوۡنَ فِیۡمَا لَیۡسَ لَکُمۡ بِهٖ عِلۡمٌ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ وَ اَنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ
তোমরা তো এমন যে- যে বিষয়ে তোমাদের কিছু জ্ঞান ছিল; সে বিষয়ে তর্ক করছো। তাহলে যে বিষয়ে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই, কেন সে বিষয়ে তর্ক করছো? বস্তুতঃ আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৬৬)
৩. مَا کَانَ اِبۡرٰهِیۡمُ یَهُوۡدِیًّا وَّ لَا نَصۡرَانِیًّا وَّ لٰکِنۡ کَانَ حَنِیۡفًا مُّسۡلِمًا ؕ وَ مَا کَانَ مِنَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ
ইবরাহিম ইয়াহুদিও ছিল না, খ্রিস্টানও ছিলেন না; তিনি ছিল (হানিফ) একনিষ্ঠ, আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম)। তিনি শিরককারীদের দলভুক্ত ছিলেন না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৬৭)
ইয়াহুদিরা বলত যে, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ছিলেন ইয়াহুদি। সুতরাং আমরা তারই ধর্মে রয়েছি। খ্রিস্টানরাও নিজেদের ব্যাপারে একই কথা বলতো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে আহলে কিতাবগণ! ইবরাহিম তোমাদের ধর্মানুসারী ছিলেন এ ধারণা করে কেন তোমরা ইবরাহিম সম্পর্কে তর্ক কর, বাদানুবাদ কর। অথচ তাওরাত ও ইঞ্জিল (ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ) তার (আগমনের) দীর্ঘকাল পরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর এ দুই কিতাব অবর্তীণ হওয়ার পর ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের উদ্ভব হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের এ কথা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। তা কি তোমরা বুঝ না?
ওহে, তোমরা ভেবে দেখ! যে বিষয়ে তোমাদের কিছু জ্ঞান আছে যেমন- হজরত মুসা ও ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যে, তোমরা তাদের ধর্মের অনুসারী; সে বিষয়ে তর্ক কর। আর যে বিষয়ে জ্ঞান নেই; যেমন- ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে, সে বিষয়ে কেন তর্ক করছ? তাঁর বিষয়ে মহান আল্লাহর জ্ঞান আছে, আর তোমরা এ সম্পর্কে জ্ঞাত নও।
তাদের সঙ্গে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের কোনো সম্পর্ক নেই মর্মে আল্লাহ তাঁর প্রকৃত পরিচয় নিজেই এভাবে তুলে ধরেন-
‘ইবরাহিম ইয়াহুদিও ছিল না, খ্রিস্টানও ছিল না। তিনি ছিলেন হানিফ। সব মিথ্যা ধর্ম থেকে বিমুখ হয়ে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত এই মনোনীত জীবন ব্যবস্থার প্রতি একনিষ্ঠ, একত্ববাদে বিশ্বাসী মুসলিম আর তিনি অংশীদার স্থাপনকারীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না।’
উল্লেখ্য, যারা ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগে তাঁর অনুসরণ করেছিল তারা এবং এ নবি (মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অধিকাংশ বিষয়ই তার শরিয়তের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। আর তাঁর (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে ইবরাহিম (আলাইহিস সালাম) ঘনিষ্ঠতম। ইবরাহিম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে এরাই বেশি হকদার। সুতরাং তোমরা নয়; বরং তাদের জন্যই বলা উচিত হবে যে, আমরা তাঁর (ইবরাহিম আলাইহিস সালামের) ধর্মের অনুসারী। আর আল্লাহর বিশ্বাসীদের অভিভাবক। তাদের সাহায্যকারী এবং রক্ষাকারী। (তাফসিরে জালালাইন)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে, হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সর্বশেষ দোয়ার ফসল তাও ওঠে এসেছে কোরআন-সুন্নাহর বর্ণনায়। তাহলো-
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজ বংশ থেকে একজন রাসুল পাঠাতে আল্লাহর কাছে এভাবে দোয়া করলেন-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيْهِمْ رَسُوْلًا مِّنْهُمْ يَتْلُوْا عَلَيْهِمْ اٰيٰتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيْهِمْ ؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِيْزُ الْحَكِيْمُ
‘হে আমাদের রব! আর তাদের মধ্য থেকে তাদের কাছে এক রসূল প্রেরণ কর। যে তোমার আয়াতসমূহ তাদের কাছে পাঠ করবে; তাদেরকে কিতাব (ধর্মগ্রন্থ কোরআন) ও হিকমত (কোরআনের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা) শেখাবে এবং তাদেরকে (শিরক থেকে) পবিত্র করবে। নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’
আবার এ দোয়া প্রসঙ্গে নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-
‘আমি হলাম আমার পিতা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দোয়া, ঈসা আলাইহিস সালামের সুসংবাদ এবং আমার জননীর (আমিনার) স্বপ্ন।’ (ফাতহুর রাব্বানি)
সুতরাং মুসলিম মুখে দাবি করার বিষয় নয়-
নাজরানের প্রতিনিধি দল যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসেছিল তখন তিনি তাদের বলেছিলেন, ‘তোমরা মুসলিম হয়ে যাও’। সে সময় তারা বলেছিল, আমরা তো মুসলিমই। খ্রিস্টান প্রতিনিধি দলের এ কথায় বুঝা গিয়েছিল যে, মুসলিমদের মতো তাদেরও দাবি ছিল- ‘তারা মুসলিম’।
অনুরূপভাবে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের সামনে তাওহিদের কথা বলা হলে তারা বলত- আমরাও মহান আল্লাহকে এক বলি। বরং যে কোনো ধর্মাবলম্বী কোনো না কোনো রঙের এক পর্যায়ে গিয়ে স্বীকার করে যে, বড় আল্লাহ একজনই। এ আয়াতে সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
ইবরাহিম আলাইহিস সালামের অনুসারীদের ধর্মবিশ্বাস
হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর অনুসারীদের প্রকৃত ধর্ম বিশ্বাস ছিল- আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা। তিনি ও তাঁর অনুসারী মহান আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন। আর ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের দাবি ছিল যে- ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুসারি ছিলেন (নাউজুবিল্লাহ)।
কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তাআলা সে দাবি খণ্ডন করেছেন। আরও জানিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীতে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের আগমনের প্রায় হাজার বছর আগে আল্লাহ তাআলা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। সুতরাং তাদের কারোর পক্ষেই ইবরাহিম আলাইহিস সালামের অনুসারী হওয়ার সম্ভাবনা মোটেই ছিল না।
আবার এ কথাও সুস্পষ্ট যে, বর্তমান সময়ে যে অর্থে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানরা তাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুসারি বলে দাবি করছে, সে অর্থে হজরত মুসা ও ঈসা আলাইহিস সালাম ইয়াহুদি ও খ্রিস্টান নয়।
মনে রাখতে হবে
মুখে মুসলিম দাবি করলেই ইসলামের অনুসারি হওয়া যায় না। কেউ মুখে ‘আমি মুসলিম’ বলে ঘোষণা দিলেই মুসলিম হয়ে যাবে না। বরং মুসলিম হওয়ার জন্য কুরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনা অনুযায়ী জীবন পরিচালনার বিকল্প নেই। যা ওঠে এসেছে কুরআনুল কারিমের উল্লেখিত আয়াতে কারিমায়।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনুল কারিমের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের ইসলামের অনুসারি হিসেবে তৈরি করার তাওফিক দান করুন। দাওয়াত ও তাবলিগে বিশ্বনবির শেখানো পদ্ধতিতে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।