শিরোনাম
ঢাকায় বসে ২/৩ মাস আগে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। ঢাকায় না পেরে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে কৌশলে নেওয়া হয় কলকাতায়। সেখানে তাকে হত্যার পর শরীর টুকরো টুকরো করে হাড্ডি থেকে মাংস আলাদা করা হয়। এরপর হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ওই বাসা থেকে বের করা হয়েছে। তবে কোথায় মরদেহের খণ্ডিত অংশ ফেলা হয়েছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।
তিনি বলেন, সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যার পরিকল্পনা হয় দুই থেকে তিন মাস আগে। তারা পরিকল্পনা করেছিল ঢাকায় হত্যা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের নজরদারি ও ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের পরে সব হত্যার ক্লু পুলিশ বের করে নেবে বলেই হত্যাকারীরা কলকাতায় এ ঘটানা ঘটিয়েছে।
হারুন অর রশীদ বলেন, অপরাধীরা বিদেশের মাটিতে অপরাধ করলে বাংলাদেশ পুলিশের নজরে আসবে না বলেই কলকাতা বেছে নেয়। বাংলাদেশের মাটিতে অপরাধ করার সাহস পায়নি। তবে তারা এ হত্যাকাণ্ডের পর পালিয়ে থাকতে পারেনি। আমরা তিনজকে গ্রেপ্তার করেছি। আরও কয়েকজনকে নজরাদিতে রাখা হয়েছে।
হারুন বলেন, মাস্টারমাইন আখতারুজ্জামানের বাসা একটি গুলশানে, একটি বসুন্ধরা এলাকায়। এই দুই বাসাতেই অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করেছে। আনারকে হত্যার নেপথ্যে রাজনীতি বা অর্থনৈতিক যে কারণেই থাকুক না কেন বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা কলকাতায় গত ২৫ তারিখ একটি বাসা ভাড়া নেয়। তারা ৩০ এপ্রিল ওই বাসায় ওঠে। যিনি হত্যার পরিকল্পনা করেছেন তিনিও আরেকজনসহ মোট তিনজন বিমানে করে কলকাতার ভাড়া বাসায় ওঠেন।
তারা দুই মাস ধরে খেয়াল রাখছে কখন আনারকে কলকাতায় আনা যাবো। সেখানে আরও দুজনকে হায়ার করা হয়। তারা ওই বাসায় আসা যাওয়া করবে। তারা হলেন, জিহাদ বা জাহিদ ও সিয়াম। মাস্টারমাইন্ড গাড়ি ঠিক করে। কাকে কত টাকা দিতে হবে। কারা কারা হত্যায় থাকবে, কার দায়িত্ব কী হবে। কিছু কাজ আছে বলে ৫/৬ জন রেখে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসেন আখতারুজ্জামান শাহীন।
গত ১২ মে আনার তার ভারতীয় বন্ধু গোপালের বাসায় যায়। ১৩ তারিখ ওই ভাড়া বাসায় ওঠেন। ফয়সাল নামে একজন তাকে রিসিভ করেন। সেখান থেকে নিয়ে যিনি মূল হত্যাকারী তিনি আনার ও ফয়সালকে নিয়ে চালক রাজার গাড়িতে করে ওই বাসায় যায়। আগে থেকে অবস্থান করা মোস্তাফিজও বাসায় ঢোকেন। আগে সেখানে ভেতরে ছিল জাহিদ, সিয়াম। আধা ঘণ্টার মধ্যে নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, ভিকটিমের মোবাইল নম্বর থেকে মেসেজ আদান-প্রদান করা হয়, যাতে করে ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যাতে করে তদন্তে বেগ পায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, বিদেশের মাটিতে হত্যার কাজটি সংঘটিত করবে। হত্যার পর তার লাশ এমনভাবে গুম করে দেওয়া হবে যাতে করে কেউ কোনোদিন খুঁজে না পায়। হত্যার পর তার শরীর বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয়েছে। হাড়-হাড্ডি থেকে শরীরের মাংস আলাদা করা হয়েছে। এরপর গ্রে কালারের লাগেজে ভরে মূল হত্যাকারী যিনি আমাদের কাছে আছেন তিনি, জাহিদ ব্রিফকেস নিয়ে বের হয়। এরপর সিয়াম পাবলিক টয়লেটের কাছে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিল। সেখানে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখানে আসেন আরেকজন তিনি আমানুল্লাহ। ভারতীয় চালকসহ তারা গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
মূল যে হত্যাকারী তিনি বাসায় চলে যান। পরবর্তী সময়ে ২/৩ জন মিলে আনারের খণ্ড বিখণ্ড শরীর কয়েকটি ব্যাগে ভরে নিয়ে যায়। তারা এমন নৃশংস কায়দায় হত্যার কাজটি সংঘটিত করেছে যাতে করে ধরা না পড়ে। সেজন্য তারা হাড়-গোড় মাংস আলাদা করেন, হলুদ মিশিয়ে দেন। যাতে করে কেউ বললেও বলতে পারে বাজার থেকে আনা। উদ্দেশ্য একটাই ছিল যে, কেউ যেন কোনো দিন আনারের অস্তিত্ব খুঁজে না পায়।
১৫ মে মূল হত্যাকারী, গার্লফ্রেন্ডসহ ফিরে আসে। ১৫ মে মোস্তাফিজ ফিরে আসে বাংলাদেশে। সবাই যখন ফিরে আসে তখন মূল পরিকল্পনাকারী শাহীন ভিস্তারা এয়ারলাইনসে দিল্লি হয়ে দুই ঘণ্টার ট্রানজিট নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডু চলে যান। সেখান থেকে হয়ত সে অন্য কোথায় চলে যেতে পারে।
এই হত্যাকাণ্ডটা পরিকল্পিত। তারা দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ খুঁজেই হত্যা করেছে। আমরা ১৮ মের পর তদন্ত শুরু করেছি। যখন গোপাল কলকাতায় সাধারণ ডায়েরি করেন। হত্যাকারীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে বিভিন্ন মেসেজ পাঠিয়ে যে তিনি জীবিত আছেন।
ম্যাসেজ এমন ছিল যে, “আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত সাহার কাছে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী সেখানে যাবেন। তার মন্ত্রী হওয়া নিয়ে কথা হবে।” আসলে আনারের ডিভাইস ব্যবহার করে এসব মেসেজ দিয়েছে হত্যাকারীরা। তারা কখনো বেনাপোল, মুজাফফরাবাদ, কখনো পশ্চিমবঙ্গের শেষ বর্ডারে। সেখান থেকে তারা মেসেজ দিয়ে গেছে। তদন্তকারীরা যাতে ডিভাইসটা খুঁজে না পায় সেটিও তারা করেছে।
সবকিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। আমাদের কাছে আটক তিনজন স্বীকার করেছেন। আমাদের সঙ্গে কলকাতা পুলিশ, কলকাতা সিআইডি এসটিএফের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।
ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, আজকে ইন্ডিয়ান একটি তদন্ত সংশ্লিষ্ট টিম আমাদের এখানে আসবেন। আমাদের হাতে আটক যে আসামি রয়েছে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন, জিজ্ঞাসা করবেন। আমরাও প্রয়োজনে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে অনুমতি নিয়ে ঘটনাস্থলে যাবো। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের মাটিতে তারা এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটাতে পারেনি।
মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহিন। শাহিনের গার্লফ্রেন্ড শিলিস্তি রহমান। মূল হত্যাকারী বা সংঘটক তার নাম আমানুল্লাহ। তার আসল নাম কিন্তু আমানুল্লাহ না। তিনি মিথ্যে নামে পাসপোর্টটি করেছেন। তার আসল নাম আসলে শিমুল ভূইয়া। যিনি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির বড় নেতা ছিলেন। তার নামে অনেকগুলো হত্যা মামলা রয়েছে। আনার হত্যার ঘটনাটি আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি।
মরদেহ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কি-না? জানতে চাইলে হারুন বলেন, লাশ পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু বলা সম্ভব না। তবে শিমুলের বর্ণনা মতে আসলে আনারের মরদেহ তো খণ্ড খণ্ড করা হয়েছে। হাড়-হাড্ডি মাংস আলাদা করে হলুদ মিশিয়ে ব্যাগে ভরে ফেলা হয়েছে। আমরা আসলে কাজ করছি। মামলা আগেই হতে পারে। কলকাতা পুলিশ তো নিশ্চিত হয়েছে হত্যা হয়েছে। যে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করেছে সে কলকাতা পুলিশের কাছে আছে। সব কিছু মিলিয়ে আমরা তদন্ত করছি। কেন হত্যাকাণ্ড সেটি তো বের হবেই, তবে কারা কারা জড়িত, আরও কেউ জড়িত কিনা, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। আমরা আশা করছি পুরোপুরি না পেলেও খণ্ডিত হলেও মরদেহ উদ্ধার সম্ভব হবে।
হারুন আরও বলেন, আমাদের কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সব অপরাধীকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা। কী কারণে হত্যা সেটা পরে দেখবো। ইন্ডিয়াতে যারা যারা সহযোগিতা করেছে তাদের সঙ্গে টাকা-পয়সার লেনদেন করেছে মূল মাস্টারমাইন্ড। আমাদের কাছে তিনজন আছে। কলকাতা পুলিশের কাছে আছে একজন।
আমরা তদন্তের স্বার্থে অনেক কিছু বলছি না। তবে যে তিনজনকে আমরা ধরেছি তারা সবাই পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে অনেক অপরাধের অভিযোগ। ওই আখতারুজ্জামান শাহিনের কথিত গার্লফ্রেন্ড শিলাস্তি রহমানও আমাদের কাছে রয়েছে।