শিরোনাম
একটি শিশুর জীবনের ভীত রচনার গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে প্রথম ১০০০ দিন। এক্ষেত্রে সময়টাকে আমরা হিসাব করি- মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় ২৭০ দিন এবং জন্ম নেওয়ার পর দুই বছর তথা ৭৩০ দিন পর্যন্ত।
এই দুটি ভাগই অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি শিশুর নিউট্রিশন প্ল্যাটফর্ম শক্ত করার জন্য। এই সময় যদি আমরা শিশুকে সঠিক পুষ্টির যোগান দিতে পারি, তাহলে তার ভবিষ্যৎ পুষ্টির প্ল্যাটফর্ম অনেক শক্ত হবে। তখনই আপনার শিশু ভবিষ্যতে মেধাবী এবং দক্ষ হয়ে বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন পুষ্টিবিদ তপতী সাহা।
মা যখন গর্ভবতী থাকবেন, তখন থেকেই এই পুষ্টিকর সংস্থান করতে হবে। গর্ভকালীন অবস্থা থেকে যদি আমরা এই পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে স্তন্যপান করানো পর্যন্ত আমরা এই পুষ্টিকর খাবার অব্যাহত রাখতে পারবো। মায়ের খাবারে কিন্তু অনেক নিউট্রিশন যুক্ত হয় এবং এর চাহিদা স্তন্যদানের সময় আরও বেড়ে যায়। এই নিউট্রিয়েন্টগুলো হচ্ছে ভিটামিন ‘এ’, ‘ডি’ এবং ফলিক এই জাতীয় কিছু খাবার।
এসব খাবারগুলো কিন্তু আমরা প্রতিদিন খাচ্ছি। এই খাবারগুলো যদি আমরা মায়ের খাবারে যুক্ত করি, তাহলে এই পুষ্টিগুলো মা সহজেই পাবে। তবে সবসময় যে খাবার থেকে পুষ্টি নিশ্চিত করা যায়, তেমন নয়। কিছু কিছু সাপ্লিমেন্ট চিকিৎসকরা দিয়ে থাকেন। তবে সেক্ষেত্রে পরিকল্পনা অনুযায়ী খাবারগুলো মাকে দিতে হবে। যদি মায়ের যত্ন আমরা নিশ্চিত করতে না পারি, তাহলে শিশুর যত্ন বা বেড়ে ওঠা কোনোটাই ঠিক মতো হবে না। এক্ষেত্রে বাচ্চার দিকে বেশি জোর দেওয়ার কারণে মা নিজের প্রতিও অনেকটা অসচেতন হয়ে পড়েন। নিজের খাবার-দাবার, নিজের যত্নের অভাব এবং অনেক বেশি স্ট্রেসের মধ্যে মা যে বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করান, সে কারণে বাচ্চাও ঠিকমতো পুষ্টি পায় না।
একটি শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন তার বয়স ছয় মাস পর্যন্ত তাকে এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিং তথা শুধু বুকের দুধ পান করোনার পরামর্শ দিয়ে থাকি আমরা। মা যখন বাচ্চাকে ব্রেস্ট ফিডিং করায়, তখন ক্যালরির চাহিদা অনেক বেশি পরিমাণে বেড়ে যায়। এই সময় আমরা অথেন্টিক ডায়েট চার্ট ফলো করার পরামর্শ দেই।
এ সময় একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার যতটুকু ক্যালরি দরকার, তার সঙ্গে আমরা ৫০০ গ্রাম ক্যালরি বাড়িয়ে দেই। অর্থাৎ মা যতটুকু ক্যালরি গ্রহণ করছেন, তার সঙ্গে আরও ৫০০ গ্রাম ক্যালরি মায়ের খাবারে যোগ করতে হবে। অতিরিক্ত ২৫ থেকে ২৬ গ্রাম প্রোটিনও মায়ের খাবারে যুক্ত করতে হবে। সেটা অবশ্যই ফার্স্টক্লাস প্রোটিন অর্থাৎ প্রাণিজ প্রোটিন হতে হবে। অর্থাৎ মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, বিভিন্ন ধরনের বাদাম, চিজ এসব খাবার অবশ্যই মায়ের খাবারে রাখতে হবে। নয়তো মায়ের বুকের দুধের মান আস্তে আস্তে কমে যায়।
এছাড়া ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড যুক্ত খাবার খেতে হবে। এসকল খাবার বাচ্চার ব্রেইন ডেভলপমেন্টের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাচ্চার হাড় এবং দাঁতের গঠনের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আমরা পাব কাঠবাদাম, কিছু সামুদ্রিক মাছ থেকে। এছাড়া আমাদের কিছু দেশীয় মাছেও পাওয়া যায়। যেমন- দেশীয় মাগুর মাছে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড পাওয়া যায়।
কাঠবাদামে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ‘ই’ পাওয়া যায়। ভিটামিন ‘ই’ গর্ভের শিশুর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভিটামিন ‘ই’ সমৃদ্ধ খাবারগুলো হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের অনেক ভালো উৎস। এসব খাবার আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। গাঢ় রঙিন শাকসবজি, ফলমূল এগুলো হচ্ছে ভিটামিন ‘ই’র ভালো উৎস। এছাড়াও এসব খাবার মা এবং শিশুর ত্বক ভালো রাখবে। তাই ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবারগুলো আমরা মায়ের খাবারে রাখতে বলি।
পাশাপাশি ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো আমরা মায়ের খাবারের তালিকায় রাখতে বলি। যেমন- হচ্ছে শাকসবজি, দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার, কাটাসহ ছোট মাছ। তো এ ধরনের খাবারগুলো ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস। এই সকল ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবারগুলো যদি মা খেলে শিশু যদি ১০০ মিলি দুধ পায়, তার মধ্যে ৩০ মিলি ক্যালসিয়াম মায়ের বুকের দুধ থেকে পায়।
সাধারণত আমরা ডায়েট প্ল্যানে মাকে দুই গ্লাস দুধ প্রতিদিন দিয়ে থাকি। এক গ্লাস দুধ থেকেই মা অনেকখানি ভিটামিন, মিনারেলস এবং ক্যালসিয়াম পাচ্ছে। এখান থেকে মা ফ্লুইডও পাচ্ছে। কারণ, ফ্লুইড মায়ের শরীরের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বুকের দুধের ভলিউম এবং কোয়ালিটি বাড়ানোর জন্য।
শাকসবজিতে আমরা বেশি পরিমাণে ফাইবার পেয়ে থাকি। যেহেতু মা বাচ্চাকে বারবার ব্রেস্ট ফিডিং করায়, সেক্ষেত্রে মায়ের শরীর ডিহাইড্রেশন থেকে কনস্টিপেশন তথা কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ফলে এ সময় মায়েরা পাইলস থেকে শুরু করে আরও অনেক সমস্যায় পড়েন। এজন্য আঁশ জাতীয় খাবারের কোনো বিকল্প নেই। তাই প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি যেমন- পালং শাক, কচু শাক, কলমি শাক সব ধরনের শাক খেতে হবে। এছাড়া গাঢ় রঙিন সবজি খেতে হবে এবং ওটস খেতে হবে। ওটস মায়ের বুকের দুধের ভলিউম বাড়াতে সাহায্য করে। স্তন্যদান সময়কালীন মায়েরা বুকের দুধের ভলিউম বাড়ানোর জন্য সকালের নাশতা বা বিকালের নাশতায় ওটস খেতে পারেন। এর ফলে কনস্টিপেশনের সমস্যা থেকেও মুক্তি পাবেন।
এছাড়াও মায়ের খাবারে এ সময় আমরা দেশি ফল বা সিজনাল ফলগুলো রাখতে বলি। যেমন- পেয়ারা, আমড়া, বেল। যে সিজনে যে সকল ফল পাওয়া যায়, সে সকল ফলগুলো মায়ের অবশ্যই খেতে হবে। কারণ এগুলো থেকে ভালো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, মিনারেল পাওয়া যায়।
স্তন্যদান সময়কালে আমরা মায়েদের প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়ার জন্য বলি। কারণ বাচ্চা হওয়ার পর পরই মা বাচ্চাকে দুধ দিতে পারেন না। এজন্য আমরা বলি মায়েদের প্রচুর পরিমাণে পানি খাওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে মায়ের প্রতিদিন অবশ্যই দুই থেকে আড়াই লিটার পরিমাণ পানি খেতে হবে।
এছাড়া বাচ্চাকে যখন দুধ খাওয়াবেন, তার আগে এক গ্লাস পানি বা ফ্রেশ কোনো জুস বা স্যুপ খেয়ে নিতে পারেন। তারপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়াবেন। দুধ খাওয়ানোর পর আবারও পানি খেয়ে নেবেন। কারণ মা হাইড্রেটেড থাকলে বাচ্চা দুধ পাবে। এ সময় মাকে ওয়াটারি বেইজড শাকসবজিগুলো খেতে হবে যেমন- লাউ, চাল কুমড়া, পেঁপে। এখান থেকেও মা ফ্লুইডের চাহিদা পূরণ করতে পারছেন।
আর যে সব খাবারগুলো আমরা এড়িয়ে চলতে বলি, কম খাওয়ার জন্য বা খেতে মানা করি, সেগুলো হচ্ছে অতিরিক্ত ভাজা-ভূনা, তেল জাতীয় খাবার, অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার এবং প্রসেসড ফুড। অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার বাদ দিয়ে সহজপাচ্য খাবারগুলো এ সময় মায়েদের বেশি করে খেতে হবে। এ সময়ে মায়ের অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। কারণ মায়ের মাধ্যমেই শিশুর শরীরের পুষ্টি চাহিদা পূরণ হয়।